দু’দিন ব্যাপী বালু নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান শুরু জানালেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন
দূষণ ও দখলের কবলে বালু নদী, পঁচা দূর্গন্ধে পরিবেশ হুমকির মুখে পরিবেশ
মো: শাকিল আহম্মেদ প্রতিনিধি , রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ :
রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া পূর্ণবাসন কেন্দ্র এলাকা থেকে শুরু হওয়া বালু নদী এখন দূষণ ও দখলের কবলে পড়েছে। এক শ্রেনীর প্রভাবশালী নদী দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে নদীর প্রসস্থতা কমিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নদী দূষণ করছে তারা। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা না নেয়ায় এতোদিন দখল ও দূষণ অব্যাহত রেখেছেন। এতে নদীর শাখা প্রশাখা গুলো , দূষণ ও নাব্যতা সঙ্কটে ভুগছে। দূষণের কারনে নদীর পানিতে পঁচা গন্ধে পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। স্থানীয়দের আবেদন ও ক্ষোভের মুখে সম্প্রতি সরকারের এ বিষয়ে টনক নড়ে। তাদের দাবী অব্যাহত নদী দূষণের ফলে জলজ পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ছে। এতে মৎস্য সম্পদ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাই গত শনিবার ও রোববার দু’দিন ব্যাপী বালু নদী পরিদর্শণ করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ একটি প্রতিনিধিদল। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদানের নেতৃত্বে পরিদর্শণে উপস্থিত ছিলেন, ভূমি রেকর্ড ও জরীপ অধিদপ্তরের উপ-সচিব শাহাদাত হোসেন, ঢাকা জেলার এডিসি (রেভিনিউ) আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাফ, পানি উন্নয়নবোর্ডের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মতিন, রাজউকের অথরাইজড অফিসার মাকিদ এহসান, বিআইডব্লিউটিএর ট্রেসার আব্দুল হাই, কালীগঞ্জ উপজেলার ইউএনও শিবলি সাদিক, রূপগঞ্জের এসিল্যান্ড তরিকুল ইসলাম, তেজগাঁও সার্কেলের এসিল্যান্ড এবিএম কুদরত ই খুদাসহ রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের একটি প্রতিনিধিদলসহবিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা। পরিদর্শণকালে দেখা গেছে, ৫৪ স্থানে দখল ও ২৩ স্থানে দুষণ করছে প্রভাবশালীরা।
এ প্রসঙ্গে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, যে কোন মুল্যে নদী বাঁচাতে হবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবেনা। যারা নদী দখল ও দূষণ করেছেন, তারা যে ব্যক্তি, যে গোষ্ঠি, যে রাজনৈতিক দল বা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন কোন ছাড় দেয়া হবেনা। আমরা সিএস রেকর্ড দেখে সীমানা নির্ধারণ করে নদী দখলমুক্ত কার্যক্রম শুরু করবো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে শীগ্রই দখল ও দুষণ মুক্ত করে নদীকে পুর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। তাই সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন তিনি।
নদী রক্ষা কমিশন সুত্রে জানা যায়, বালু নদীর উৎসবমুখ শ্রীপুর উপজেলার মার্টা ইউনিয়নের প্রহলাদপুর মৌজায় যেখানে সৃতী ও পারুলী নদী মিলিত হয়েছে। এই মিলিত ধারা বালু নাম নিয়ে গাজীপুর ও ঢাকার মধ্যে দিয়ে রূপগঞ্জ হয়ে ডেমড়ার শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলিত হয়েছে। পুবাইলে অপর গুরুত্বপুর্ণ উপনদী চেলাই ও টঙ্গীতে টঙ্গীরখালে মিলিত হয়েছে। বালু নদীর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার ও প্রশস্থ্য ১০০ মিটার। এর শুল্ক মৌসুমের প্রবাহ ৬০ ঘনমিটার ও বর্ষা মৌসুমে ৭৪৪ ঘনমিটার। এর গভীরতা রূপগঞ্জ ও ডেমড়া পয়েন্টে ৫.৮৫ মিটার থেকে ৯.৬৩ মিটার। এর অববাহিকা প্রায় ৭২২ বর্গকিলোমিটারের চেয়েও অধিক। এই নদীর গতিপথে দুইটি পানির লেভেল পরিমাপক ষ্টেশন একটি পুবাইল ও অন্যটি ডেমরায় এবং একটি প্রবাহ পরিমাপক ষ্টেশন আছে ডেমরায়। ৫৪ স্থানে দখল, ২৩ স্থানে দূষণ, ৩ স্থানে ডুবোচর, ৩স্থানে প্রায় ২৫০০ মিটার ভাঙ্গন ও ৩০টি ব্রীজ আছে। প্রায় ৪০টি খাল ও ছোট-বড় মিলিয়ে ৭টি বিলের নদীর সরাসরি সংযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, পুবাইল মৌজার সরকারী মেডিকেল এ্যসিসটেন্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নদীর জমিতে ভবন নির্মাণ ও বালু নদী কঠিক বর্জ্য সরাসরি নির্গত করছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমীর বহুতল ভবন নির্মান করা হয়েছে নদীর জমি দখল করে। মান্নান ব্রিকফিল্ড দখলে রেখেছে নদীর জমি।
এএনডি ট্রাউজার ফ্যাক্টরির বর্জ্য আবর্জনার স্তুপ ও ময়লার পাইপ সরাসরি নদীতে ফেলছে। টঙ্গী সার্কেলে বাবু গার্মেন্টস, আজমেরি গার্মেন্টস, নীলা ক্যামিকেল ফ্যাক্টরি, এল ই ডি ষ্টার ফ্যাক্টরির বর্জ্যও সরাসরি বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। কোন প্রকার ইটিভি প্লান ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠান এসব দূষণ করছে। রূপগঞ্জ ইউনিয়নের পর্শি এলাকায় ক্রাউন সিমেন্ট ফ্যাক্টরি বর্জ্য ও ময়লার স্তুপ বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। বালু নদীর দুই পারে বসবাসরত স্থানীয় জনগণও বর্জ্য ও ময়লার স্তুপ সরাসরি ফেলানো হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগের শেষ নেই।
এ বিষয়ে লেখক, কলামিস্ট, গবেষক লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, এক সময় মানুষ নদীর পানি সংগ্রহ করে রান্নার কাজের ব্যবহার করতো। এমনকি নদীর পানি পান করতেন। আজ সেই নদীর পানি পঁচা দুর্গন্ধে বিষ হয়ে উঠেছে। আর এ পানি থেকে বিষাক্ত গ্যাস হয়ে মানুষ দিন দিন অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মিলকারখানায় ইটিপি’র ব্যবস্থা না করে নদীতে সরাসরি বর্জ্য ফেলার কারনে দিন দিন নদী গুলো দূষণের কবলে পড়ছে। নদী রক্ষায় আগে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলার এডিসি (রেভিনিউ) আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা নির্দেশনা পেলে বালু নদীর দুই পাশে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবো। বিশেষ করে ঢাকা জেলার পাশাপাশি গাজীপুর জেলা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এ উচ্ছেদ অভিযান চলবে। বালু নদী রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। আগে থেকেই দখলদারদের নদী দখল মুক্ত করার জন্য বলা হলো। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আর যারা নদী দুষণ করছেন, তারাও নদী দূষণ থেকে বিরত থাকুন, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।