দৈনিক সমাজের কন্ঠ

পিতার সাথে অভিমানঃ মাত্র ১৭ টাকা নিয়ে বাড়ি ছাড়া শিল্প উদ্যোক্তার জীবনী

ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, স্কুলে পড়া সম্ভব হয়নি। লেখাপড়ায় মন ছিল না। দরিদ্র পিতার সাহায্যার্থে তাকে ব্যবসার কাজ শুরু করতে হয়। ডাব বিক্রি, চানাচুর বাদাম ফেরি করার কাজ। ব্যবসা ভুল-ভাল হলে পিতার কাছে বকা খেতে হতো। একদিন পিতাপুত্রের মধ্যে বচসা বেধে যায়। ফলে রাগ করে বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন।

এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র বারো বছর। সে সময় তার কাছে মাটির ব্যাংকে জমানো সতেরো টাকা নিয়ে তিনি এক কাপড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরবেন এই ছিল তার পণ। গভীর রাতে শিয়ালদা স্টেশনে এসে নেমে পড়ে বাড়িছাড়া বারো বছর বয়সের বালক দেখেন অসংখ্য লোক প্ল্যাটফর্মের ওপর কাগজ বিছিয়ে শুয়ে আছে। এখান থেকে আকিজ জীবনের প্রথম পাঠ নেন।

স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্মই হয় তার সেই নতুন জীবনের আশ্রয়। সারা দিন শহর বেড়িয়ে রাত কাটে তার এই স্টেশনে। এক পয়সায় কেনা খবরের কাগজ বিছিয়ে মাথার নিচে ইট দিয়ে শুয়ে থাকা। দৃঢ়-কঠিন জীবন, কিন্তু আকিজ স্বপ্ন দেখেছিলেন এক অসামান্য জীবন প্রত্যয়ের। কলকাতার পথঘাট তার অজানা। একদিন শহরের পথে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করেন বড় বাজারের রামলোচন স্ট্রিটের এক জায়গায় কমলালেবুর নিলাম হচ্ছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইলেন। অন্য অনেক ক্রেতার মতো তিনিও নিলামের ডাকে অংশ নেন এবং আড়াই টাকা দিয়ে চার ঝুড়ি কমলা কেনেন এবং নির্মাণাধীন হাওড়া ব্রিজে কমলা বিক্রি শুরু করেন। বালকটির এই ছিল কলকাতা জীবনের প্রথম ব্যবসা।

সেদিনের সেই বালকটিই পরবর্তী কালের অর্থ, সম্পদ ও মানবসেবার বিরল ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা, সমাজসেবক শেখ আকিজ উদ্দিন।

কমলা বেচে প্রথম দিনের দশ পয়সা লাভ খুব কম ছিল না আকিজ উদ্দিনের পক্ষে। কারণ তার নিজের প্রতিদিনের খরচ ছিল দুই পয়সা। তার খাদ্য ছিল ছাতু। দুই পয়সায় কেনা। স্টেশনে ঘুমাতে পয়সা লাগত না। ফলে তার লাভ খারাপ হলো না। এমন লাভ দেখে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসাটি করতে লাগলেন। এভাবে কিছুদিন ব্যবসা করার পর তিনি লক্ষ করেন তার হাতে প্রায় তিনশ টাকা জমে গেছে।

আকিজ উদ্দিন অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিলেন। প্রতিদিনের খাবারের বাইরে কিছু কিনতেন না। মিতব্যয়িতা তার জীবনের এক পরম শিক্ষা। তিনি কমলালেবুর ব্যবসায় বেশ উন্নতি করেছিলেন। জাকারিয়া স্ট্রিটের এক হোটেল মালিক তাকে হোটেলে নিয়ে এসে সস্তায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। প্রতিদিন এক আনায় আকিজ উদ্দিন খেতে পেতেন এবং রাতে হোটেলে থাকার সুযোগ পেলেন। তার স্টেশনে ভাসমান জীবনের অবসান হলো। এ সময় তার বড় অঙ্কের মূলধন হওয়ায় তিনি ব্যবসা পরিবর্তনের চিন্তা করলেন আরও ভালো ও বড় ব্যবসা কীভাবে করা যায়। তার খোঁজ করতে থাকলেন।

আকিজ উদ্দিন চমকদার এক ব্যবসার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হলেন। তিনি একটি নতুন নিলামওয়ালা ঠেলাগাড়ির দোকান কিনলেন। চমৎকার এবং আকর্ষণীয় পঁয়ত্রিশ চল্লিশটি পণ্যে দোকানটি সাজালেন। কিশোর আকিজ উদ্দিনের মুখে নিলামওয়ালা ছ’ আনা শুনে প্রচুর লোক তার দোকানে আসতে লাগল। এভাবে তার এ ব্যবসাও পুরনো দোকানিদের ছাড়িয়ে যেতে লাগল। প্রায় পুরো এক বছর আকিজ উদ্দিনের ‘নিলামওয়ালা ছ’ আনা’ ব্যবসা বেশ রমরমাভাবে চলল। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি পুলিশের খপ্পরে পড়লেন। শোনা যায়, পুরনো দোকানিরা তার বিরুদ্ধে পুলিশকে লাগিয়ে দেয়। অনুমতি ছাড়া রাস্তায় দোকান করার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

তখনকার ব্রিটিশ ভারতের শ্বেতাঙ্গ বিচারকরা কারণে-অকারণে ভারতীয়দের কঠোর শাস্তি দিত। কিন্তু আকিজ উদ্দিনের বেলায় একটু ব্যতিক্রম হলো। তার চেহারায় একটা সাধারণ লাবণ্য ছিল। ছিল একটা নিষ্পাপ উজ্জ্বল মুখ। বিচারের সময় তার এই চেহারা দেখে বিচারকের মায়া হলো। বিচারক আকিজ উদ্দিনকে মাত্র তিন দিনের জেল ও পাঁচ টাকা জরিমানা করেন। তবু নির্দোষ আকিজ উদ্দিন এই জরিমানা ও জেল খাটার কথা মনে করে ভেঙে পড়েন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি এই ব্যবসায় আর ফিরতে চাইলেন না। তিনি চার চাকার ঠেলাগাড়ি এবং দোকানের সব পণ্য বিক্রি করে দিলেন। এরপর বিষণ্ন মনে তিনি কিছুদিন বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে লাগলেন। তিনি আবার নতুন করে কোনো ব্যবসার কথা ভাবতে লাগলেন।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন পূর্বপরিচিত পেশোয়ারের এক ফল ব্যবসায়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তিনি আকিজ উদ্দিনের কাছ থেকে তার কলকাতা জীবনের সব ঘটনা শুনলেন। উদ্যমী কিশোরের গল্প তার মনে ভীষণ নাড়া দিল। আকিজ উদ্দিনের প্রতি তিনি খুব স্নেহশীল হলেন। একদিন এই পেশোয়ারী ব্যবসায়ী আকিজ উদ্দিনকে বলেন যে, তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। আকিজ উদ্দিন যদি ইচ্ছা করে তবে তার সঙ্গে সে যেতে পারে এবং সেখানে গেলে সে নিশ্চিত মনে ফলের ব্যবসা করতে পারবে। নির্ভীক আকিজ উদ্দিন তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেলেন। পেশোয়ারে তার প্রায় দু’বছর কেটে যায়। পেশোয়ারে স্বল্পকাল অবস্থান করলেও পরে জীবনে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এমনকি তার এই পেশোয়ারবাসের অভিজ্ঞতা একবার নিজের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছিল এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার সাফল্য লাভের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

পেশোয়ার যাওয়ার সময় আকিজ উদ্দিনের কাছে প্রায় দুই হাজার দুইশ টাকা ছিল। পেশোয়ারে ব্যবসা করার পর তার এই মূলধন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। তিনি এই পুঁজিকে সম্বল করেই পেশোয়ার থেকে পূর্ব দিকে রওনা হলেন। বাড়ি ফেরারও আকুতি ছিল। ১৯৪০ সালে বাড়ি ছাড়ার পরে আকিজ উদ্দিনের প্রায় চার বছর কেটে গেছে। এ সময়ের মধ্যে তিনি একবারও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কাজেই এক ধরনের উৎকণ্ঠা তার মনে কাজ করছিল।

১৯৪৫ সালের দিকে তিনি নিজ গ্রাম মধ্যডাঙ্গায় প্রত্যাবর্তন করেন। বাড়ি ফেরার সময় তার কাছে পুঁজি জমেছিল প্রায় আট হাজার টাকা। এই পুঁজি ভরসা করেই তিনি বাড়ি ফিরলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বাবা-মার মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তখন তার বয়স মাত্র উনিশ বছর। সেই বয়সে ১৯৪৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সখিনা খাতুনকে। বিয়ের পর আকিজ উদ্দিনের জীবনে বড় রকমের একটা পরিবর্তন আসে। নিজের চিন্তা ও সংকল্পের প্রতি অনড় থাকেন। শুধু সাংসারিক কাজ করে নিজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে আকিজ নষ্ট করে চাইতেন না।

স্বাধীনচেতা আকিজ উদ্দিন নিজের স্বপ্নকে সার্থক করতে চেয়েছিলেন। আর্থিক সামর্থ্য স্বল্প হলেও তিনি আত্মবিশ্বাসের প্রতি অটল ছিলেন।

১৯৫২ সালে আকিজ প্রথম বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাটির ধারণা তিনি পেয়েছিলেন নিতাই চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে। সেই সময়ের বিখ্যাত ‘বিধু’ বিড়ির মালিক বিধুভূষণ ছিলেন তারই এক বন্ধুর বাবা। তার অনুপ্রেরণাতেই আকিজ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বিড়ির ব্যবসাটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করেন। ধীরে ধীরে বেজেরডাঙ্গা তার নিজ এলাকায় রেলস্টেশনের পাশে একটি মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে এই দোকানে তার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ষাট হাজার টাকা। এক রাতে আকিজের পুরো দোকানটি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অসীম ধৈর্যশীল আকিজ এতটুকু ভেঙে পড়েননি তাতে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অচিরেই তিনি গড়ে তোলেন নতুন দোকান। তার সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও নিরলস পরিশ্রমের ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মোট মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ টাকা। এরই পাশাপাশি আকিজ শুরু করেন ধান, পাট, চাল, ডাল, গুড় প্রভৃতির খুচরা ব্যবসা।

সমস্ত ক্ষেত্রেই আকিজের প্রধান মূলধন ছিল বিশ্বস্ততা। ব্যবসায়ী মহলের সবাই তাকে একবাক্যে বিশ্বাস করতেন। পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকের দিকে নাভারণ পুরাতন বাজারে বিড়ির ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটান এবং গড়ে তোলেন দেশের সর্ববৃহৎ আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি। নতুন নতুন উদ্ভাবনী মেধায় তিনি উন্মোচন করেন ব্যবসার নানা দিগন্ত। একে একে গড়ে তোলেন আকিজ তামাক ফ্যাক্টরি, আকিজ নেভিগেশন, আকিজ জুট মিল, আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি, আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

এখন প্রায় ষাট হাজার কর্মী তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা আয়কর পরিশোধ করেন। এসবের পেছনে ছিল তার সকাল থেকে রাত অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধা।

শেখ আকিজ উদ্দিন জীবনের সব শ্রম-সাধনা কেবলমাত্র নিজকে প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেননি।

শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি একজন সফল সমাজসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছোটবেলায় দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের করুণ অবস্থা উপলব্ধি করেই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শরিফ হোসেনের সহায়তায় ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আদ্-দ্বীন। বর্তমানে এই সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠান আদ্-দ্বীন মহিলা, শিশু ও চক্ষু হাসপাতাল সারা দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। তার অর্থায়নে পরিচালিত আকিজ কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যশোর শিক্ষা বোর্ডের সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম বহন করে আসছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এমন একজন স্বনির্মিত সফল শিল্প উদ্যোক্তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। বাস্তব অভিজ্ঞতাই তার পুরো জীবনের নিয়ন্ত্রক। অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া জ্ঞান তিনি সহজেই নিজের জীবনে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষা বিশাল শিল্প পরিবার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়নি। মেধা ও প্রতিভার সমন্বয়ে গড়ে তোলা তার প্রতিষ্ঠানে এখন হাজার হাজার শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

– মরহুম শিল্পপতি জনাব আকিজ উদ্দিনকে পরম করুনাময় আল্লাহ পাক বেহেস্ত দান করুন, আমীন।

 

@ সংগৃহীত ও সংযোজিত