দৈনিক সমাজের কন্ঠ

অভয়নগর সহ বিস্তৃত অঞ্চলের অসহায়দের ডাক্তার ছিলেন আঃ সামাদ

 সুনীল দাস – মরহুম আব্দুস সামাদ গাজী ছিলেন একজন গ্রাম্য ডাক্তার,মানব দরদী-অসাম্প্রদায়িক। দুইয়ের মিশেল তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল মানুষের কাছে। অভয়নগর এবং ঝিকরগাছা, চৌগাছা, ফুলতলা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ইত্যাদি এলাকায় তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। লোকে একনামে তাঁকে “সামাদ ডাক্তার” বলেই জানত। শুধু তাই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই মানুষ আসত যারা বড় বড় হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারদের কাছ থেকে জীবনের শেষ জেনেই আসত শেষচেষ্টার আশায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছায় অনেকেই নতুন করে বাঁচতে শুরু করে তাঁর চিকিৎসার ওছিলায়। কী যেন এক যাদু ছিল তাঁর মাঝে। কখনো চাউলের গুঁড়ার তৈরি পুরিয়া, কখনো সিরিন্জ ভর্তি পানি দিয়েই ইনজেকশন ! তাতেই যে কোন অসুখ যেন ভাল হয়ে যেত। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক (দেহের অঙ্গপঁচন রোগ) রোগী আসত যাদের অধিকাংশই তাঁর চিকিৎসায় পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হন। স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী বা পরবর্তী বা যুদ্ধকালীন সময় থেকে শুরু করে তাঁর সেবায় অগণিত মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেন। বিশ্বস্তসূত্রে শোনা এই যে, যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের অভয়নগরের নওয়াপাড়া রেলস্টেশনে পাক হানাদার বাহিনীরা অত্যাচারের পর প্রায়ই অসংখ্য মানুষকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রেনে করে এনে আহত বা অর্ধমৃত বা মৃত অবস্থায় ফেলে রেখে যেত। এখনো উক্ত স্টেশনের পাশেই অজ্ঞাত লাশের বধ্যভূমি রয়েছে। ঐ সময়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলনা, ছিলনা পর্যাপ্ত ডাক্তার। ডাঃ আব্দুস সামাদ তাঁর সাধ্যমত ঐ পীড়িত মানুষদের সেবা করেছেন নিজের বাড়িতে এনে বা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গিয়ে। সবই করতে হতো গোপনে অন্যথায় রাজাকার বা পাকদের রোষানলে প্রাণনাশের ভয় ছিল। দ্রুত চলাচলের জন্য তিঁনি একটি বিশেষ সাইকেল ব্যবহার করতেন যাতে ইনজিন লাগানো ছিল এবং এটি তিঁনি নিজেই তৈরি করেছিলেন। সুস্থ থাকাকালীন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত (১৯৯৮ সাল; ১৪ মাস অসুখে ভুগেন) পর্যন্ত রাত নাই, দিন নাই, নাওয়া নাই, খাওয়া নাই যখনই কারো অসুস্থতা বা মুমূর্ষু অবস্থা তখনই তিঁনি হাজির হয়ে যেতেন কোনো অজুহাত ছাড়াই। রাতে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা থেকে অপরিচিত মানুষ বিশেষ করে পাগল, ভিক্ষুক, অনাহারী, পীড়িত, অসহায় মানুষদের সাথে করে নিয়ে আসতেন। বাড়িতে কয়েকদিন রেখে খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ করে তারপর পাঠিয়ে দিতেন। গ্রামের একমাত্র মাধ্যমিক স্কুল কখনো কারো কাছে চিকিৎসার ফিস চাইতেন না। যে যা খুশি দিয়ে যেত। এক, দুই বা সর্বোচ্চ পাঁচ টাকার নোট। এটাই কত ঐ সময়ে! টাকা লুঙ্গিতে গুঁজতে গুঁজতে লুঙ্গি একেবারে উরুর উপর উঠে যেত। সবাই চলে গেলে খাটের উপর দাঁড়িয়ে একবারে লুঙ্গিটা ঝেড়ে আবার নতুন করে বাঁধতেন। আর তাতেই ভরে যেত সমস্ত বিছানা। তার ফারহান কবির সিফাত জানিয়েছেন, কখনো আম্মু আমাকে বকলেই তিঁনি আমাকে ডেকে চুপ করে হাতে দুই টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলতেন “যাও মেঝ ভাই চিনির বিস্কুট খেয়ে আসো, কেউ যেন না দেখে।” আর ওমনি আমি সব ভুলে যেতাম তাঁর স্নেহের ছায়ায়। তিঁনি মানুষকে সাহায্য করার সময় কখনো পিছপা হতেন না, আগে-পিছে চিন্তাও করতেন না। কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই নিজের জীবনকে মানুষের তরে উৎসর্গ করে গেছেন এই মহান মানুষটি। বড় মানবিক মানুষ ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, “এই পৃথিবীতে এসে কী পেয়েছি সেটা নয় বরং এই পৃথিবীকে কী দিতে পেরেছি সেটাই মুখ্য।” অহংকার বা লোভ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্যের দিকে কখনোই ফিরে তাকাননি। তাকালে হয়তো আজ অনেক কিছুই থাকতো। থাকতো না শুধু এই নাম, কৃতকর্মের ফল – মানুষের ভক্তি, ভালবাসা আর দোয়া।। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।