সমাজের কণ্ঠ ডেস্ক : ৯ জুলাই, ২০১৯ –
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ ধরনের কথা বলাকে অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা এই অঞ্চলে শান্তিতে বিশ্বাসী। কারো ভূখণ্ড আমাদের লাগবে না।’ গতকাল সোমবার গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্তব্য করেন। গত সপ্তাহে তাঁর চীন সফরের বিষয়ে জানাতে প্রধানমন্ত্রী এই সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং তা জনগণকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির উন্নতি চাইলে গ্যাসের যে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা মেনে নিতে হবে। দাম যেটুকু বাড়ানো হয়েছে, সেটুকু যদি বাড়ানো না হয় তাহলে আমাদের সামনে দুটি পথ আছে—হয় আমাদের এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিয়ে এনার্জির ক্ষেত্র সংকুচিত করে ফেলব। তাতে উন্নতি হবে না। আর যদি সত্যিই উন্নতি চান তো এটাকে মেনে নিতে হবে।’ শুধু আমরা নই, গ্যাস আমদানিকারক দেশও এটা মেনে নেয় বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ৮.১ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এর কারণ আমরা এনার্জি ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পেরেছি এবং গ্যাস আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে। এলএনজি গ্যাস আমদানির জন্য খরচ যথেষ্ট বেশি পড়ে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবারও মিয়ানমারে যাবেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে সম্মত করতে চেষ্টা করবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, চীন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দুবার মিয়ানমারে পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করি। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে এ শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হাতে পারে বলে আমি উল্লেখ করি।’
সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন কংগ্রেসে বেন শারমেনের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, ওই কংগ্রেসম্যান প্রস্তাব দিয়েছেন রাখাইনের যে মানচিত্রটি আছে, তা বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোক। এ বিষয়ে সুদানের উদাহরণ টেনে ওই কংগ্রেসম্যান প্রশ্ন রেখেছেন, অন্যান্য জায়গায় হলে এখানে হবে না কেন?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যে সীমানা আছে আমরা তাতেই খুশি। সেখানে গৃহযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে রাখাইন প্রদেশে সার্বক্ষণিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাকে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করব কেন? এটা আমরা কখনোই করব না।
এ অঞ্চলে শান্তি কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা শান্তি চাই। যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সমস্যা সমাধানের মোড়লগিরি করেছে সেখানেই আগুন জ্বলেছে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাদের বাংলাদেশের সঙ্গে রাখাইনকে জুড়ে দেওয়ার পরামর্শ না দিয়ে মিয়ানমার কিভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, সে বিষয়ে কাজ করার তাগিদ দেন।
প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, ৬১ টাকা ১২ পয়সা করে এলএনজি আমদানি করে ৯.৮০ টাকায় দিচ্ছি। এখন যে দাম বাড়ানো হয়েছে এই দাম বাড়ানোর পরও আমাদের বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ভর্তুকি দিতে হবে। তাহলে আমদানি যখন করেছি আমরা একটা কাজ করি, যে দামে কিনব সেই দামে বিক্রি করব। আমরা ৬১ টাকা করে নিব। সমস্ত ট্যাক্স মাফ করে দেওয়া হয়েছে। সব কিছু করে দিলাম যাতে মানুষের কাছে সহজলভ্য হয় সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তার পরও উনারা হরতাল ডাকেন, আন্দোলন করেন।
সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বা সরকার যদি ভুল করে তার খেসারত জনগণকে দিতে হয় এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৪-০৫ সালে মিয়ানমারের যে গ্যাস, সেই গ্যাসে ভারত, মিয়ানমার, জাপান, চীন বিনিয়োগ করেছিল। ভারত ওই গ্যাস নিতে চেয়েছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পাইপলাইনে। একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার ওই পাইপলাইনে গ্যাসটা নিতে দেয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে যদি আমি থাকতাম তাহলে আমি কি করতাম—আমি পাইপলাইনে গ্যাস নিতে দিতাম এবং আমার ভাগটাও রেখে দিতাম। আমাকে দিয়ে তারপর নিতে হবে। আমি মিয়ানমার থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আনতে পারতাম। সেই গ্যাস যদি এনে অর্থনীতির কাজে লাগাতে পারতাম তা হলে আমাকে এখন এলএনজি আমদানি না করলেও চলত। সেই গ্যাসটা নিতে পারিনি। পুরোটা চীন কিনে নিচ্ছে। কিন্তু আমার তো আর নেওয়ার কোনো উপায় নেই।
তিনি বলেন, আমাকে শিল্পায়ন করতে হবে। আমার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমার সার উৎপাদন করতে হবে। আমার দেশের অর্থনীতির উন্নতি করতে হবে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে হবে। কাজেই আমাদের এলএনজি আমদানি করতেই হবে।
ডান বাম মিলে গেছে : গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেখেছি অনেকে আন্দোলন করছেন। বলছেন, ভারতে কমে যাচ্ছে। আমি বলি ভারতে আবাসিকে গ্যাসের মূল্য ৩০-৩৭ টাকা প্রতি ঘনমিটার। আর বাংলাদেশ দিচ্ছে মাত্র ১২.৬০ টাকায়। শিল্পে বাংলাদেশ দিচ্ছে ১০.৭০ টাকা, আর ভারতে ৪০-৪২ টাকা। সিএনজি আমাদের এখানে ৪৩ টাকা, ওদের ওখানে ৪৪ টাকা। বাণিজ্যিকে আমরা এখানে দিচ্ছি ২৩ টাকায়, আর ভারতে ৫৮-৬৩ টাকা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতে প্রতিবছর দুইবার দাম বাড়ায়। এটা তাদের নীতি, আর সেই নীতিতেই তারা চলে। ১ এপ্রিল তারা একবার বৃদ্ধি করে, এরপর আবার অক্টোবরে আরেকবার বৃদ্ধি করে। তিনি বলেন, ‘৬১ টাকা ১২ পয়সা করে এলএনজি আমদানি করে আমরা দিচ্ছি ৯ দশমিক ৮০ টাকায়। এবার বিষয়টি আপনার চিন্তা করে দেখেন। তার পরও আন্দোলন। একটা মজার বিষয় আছে বাম আর ডান মিলে গেছে, এক সুরে। খুব ভালো।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট আগামী বছর জিডিপি ৮.২ শতাংশ করব এবং ২০২৪ সালের মধ্যে এটাকে দুই অঙ্কে নিয়ে যাব। আমার এনার্জি লাগবে। ভালোভাবে বিদ্যুৎ লাগবে। এখন লোডশেডিং নাই সারা দেশে, অতীতের কথা ভুলে গেছি।’
পুরুষদেরকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান : ধর্ষণরোধে পুরুষ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পুরুষ সমাজকেও বলব, ধর্ষণটা তো পুরুষ সমাজ করে যাচ্ছে, পুরুষ সমাজেরও একটা আওয়াজ তোলা উচিত।
তিনি বলেন, ধর্ষণ প্রতিরোধে যা যা করার দরকার বা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার হলে সরকার তাই করবে। ধর্ষকদের শাস্তি দিতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর বলে জানান তিনি।
পুরুষদেরও কিছু করা উচিত জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, খালি নারীরাই চিৎস্যর করে যাবে নাকি? নির্যাতিত হয়ে সব চিৎস্যর করবে আর নির্যাতনকারীর স্বজাতি যারা আছে তাদেরও এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া উচিত বলে মনে করি।
সম্প্রতি রাজধানীর ওয়ারীতে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হওয়া শিশু সায়মার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপরাধীকে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করেছে এবং সে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে।
ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ যারা করে, তারা মানুষ না। উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
চাকরির বয়স ৩৫ নয় : সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর না করার পক্ষে যুক্তি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তিনটি বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেখা গেছে ২৩ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে যাঁরা পরীক্ষা দেন তাঁদের পাসের হার ৪০-এর ওপরে আর ২৯ বছরের পরে যাঁরা পরীক্ষা দেন তাঁদের পাসের হার ৩ শতাংশের মতো। তিনি বলেন, ৩৫ বছর হলে কী অবস্থা হবে, হয়তো পাসের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিসিএসের তিন পর্বের ফল বিশ্লেষণ করে শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, ‘কোনটা গ্রহণ করব এখন বলুন। আমি আর কিছু বলতে চাই না, আমি কেবল হিসাবটা দিলাম। চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ পর্যন্ত করলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। এখন দাবি তোলার জন্য যদি দাবি তোলা হয়, আমার কিছু বলার নেই। এ দাবি তোলার জন্য কোনো না কোনো জায়গা থেকে নিশ্চয় কোনো প্রেরণা পাচ্ছে।’
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স চমৎস্যর : বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স অত্যন্ত চমৎস্যর বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট খেলে, যেমন—বড় বড় দল তাদের পর্যন্ত হারিয়ে দিয়েছে। সাকিব, মোস্তাফিজ বিশ্বকাপে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি করছে। হয়তো সেমিতে যেতে পারেনি। চারটি দল সেমিতে গেছে। আর যে দলগুলো বাদ পড়েছে তারা সবাই কি খারাপ দল? দীর্ঘদিন ধরে যারা ক্রিকেট খেলছে তাদের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে আমাদের ছেলেরা। এই সাহসই তো বড় কথা। সবাই যে সব খেলায় জিতবে—এমন কোনো কথা না। তা ছাড়া ভাগ্যও লাগে।’
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন উপস্থিত ছিলেন