দৈনিক সমাজের কন্ঠ

রোহিঙ্গা তরুনীর উচ্চ শিক্ষা রুদ্ধ। রোহিঙ্গা রিফিউজিরা কি মানুষ নয়?

 ড, শাহরিয়ার আহমেদ –

কিছুদিন ধরেই দেখছি কিছু মিডিয়া রসিয়ে রসিয়ে বিভ্রান্তিকর নিউজ করে রোহিঙ্গাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। এসব মিডিয়া তাদের তৈরী করা নানান গালগল্প ছেপেই চলছে। মনে রাখতে হবে কিছু উশৃঙ্খল রোহিঙ্গার অপকর্মের দায় পুরো জাতির উপর বর্তায়না। আমি আগেই ভেবেছিলাম তারা কোন ষড়যন্ত্রের কবলে পড়তে যাচ্ছে, তাই হলো। এই ষড়যন্ত্র আর সিরিয়াল প্রচারণায় বিভ্রান্ত কিছু সুশীল টাইপের কনভার্টেড ইসলামীষ্ট ব্যক্তিবর্গরাও দেখি রোহিঙ্গা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে তাদের কথিত স্বাধীনতা বিনষ্ট করতে রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে তাদের জন্য হুমকি হতে পারে। তাদের ‍বুঝা উচিত, এভাবে অন্যের অধিকার ছিন্ন হতে দেখে চুপ থাকলে আল্লাহ পাক তোমাকে রিফিউজির মর্যাদায় সিক্ত করতে পারে।
.
বাংলাদেশের দুটি বড় দল মুলত ইতিহাস বিক্রি করে চলে। একটি দল তো সরাসরি একাত্তরের চেতনার ফেরিওয়ালা। অপরটি স্বাধীনতা ও সাম্য ইত্যাদির শ্লোগানে রসনা ভিজিয়ে রাখে সারাক্ষন। মজার বিষয় হলো ইতিহাস বিক্রি করা দল দুটি ভুলেই গেছে তাদের আসল ইতিহাস।
.
একাত্তরে এদেশেরই বর্তমানে এক টপ লিডার রিফিউজি ছিলেন এবং তারই সন্তান ওই সময়ে ভারতে পড়ালেখা করেছে রিফিউজি পরিচয়ে। অন্যদিকে এদেশের ভিন্ন একটি দলের আরেক টপ লিডারের পুত্র তো লন্ডনে এখন এক প্রকার রিফিউজির মতোই আছেন। তার কন্যাও পড়ালেখা করছে লন্ডনে। অথচ এই ইতিহাসটি কেউ সামনে আনেনা অতিরিক্ত চাটুকারিতার জন্য।এরকম যাদের জীবন তারা কি করে একজন রিফিউজি তরুনীর উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে পারে ? তারা মৌলিক অধিকার পেতে পারে না, তারা কি মানুষ নয়?
.
রোহিঙ্গা তরুণীকে কি কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিঃষ্কার করা ঠিক হয়েছে? মেয়েটি শুধুমাত্র পড়তে চেয়েছে, চাইনি নাগরিকত্বের অধিকার! অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সে যে সমাজেরই হোক না কেনো। জাতীয়তার কারনে একজন মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? এ কেমন বিচার?? (মেয়েটির জন্ম এদেশে, তার বাবা মা ১৯৯২ সালে এদেশে আসে) এদেশে নেপাল ভুটান থেকে এসে বহু ছাত্র পড়েন। রোহিঙ্গা বলে কেন তার পড়ালেখা বন্ধ করা হলো? মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে কি কাজটি সঠিক হয়েছে? ১২-১৩ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারলে একটি সংগ্রামী মেয়েকে পড়ালেখার জন্য নুন্যতম ছাড় দেওয়াটা কি রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতি হতো? এই জাতির মানুষত্ববোধ গেলো কোথায়!! আইন আদালত কি শুধু নির্যাতিত অসহায় দের উপর প্রয়োগ করার হাতিয়ার?

ফ্রান্সে বাংলাদেশী ফাহিম নামের এক যুবক ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ফাহিম মুহাম্মদ বাবা-মার সাথে যখন ফ্রান্সে আসে, তখন তার বয়স ৮ বছর। তারা এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে দু-বছর পরে আদালতে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। শুরু হয় ফাহিমদের
‘অবৈধ’ অভিবাসী হিসেবে বসবাস।

না, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়নি। সে স্কুলে নিয়মিত আরো দশজন ফরাসি বাচ্ছাদের মতো যাচ্ছিল। প্রখর মেধার অধিকারী ফাহিমের দাবায় ছিল মনোযোগ। ফ্রান্স ‘অবৈধতা’র দিকে না তাকিয়ে ছেলেটির মনোযোগকে মূল্যায়ন করেছে। তার পিঠে লাথি না মেরে বরং পেছনে প্রশিক্ষক লাগিয়ে দিয়েছিল। তাইতো সে হয়ে উঠেছিল একজন বিশ্ববিখ্যাত দাবাড়ু।

২০১২ সালে দাবাতে ফ্রান্সের (অনূর্ধ্ব ১২) চ্যাম্পিয়ন হতে তার ‘অবৈধতা’ কোনো সমস্যা করেনি। কিন্তু অবৈধ শরণার্থী হিসেবে আর আগাতে পারেনি। দেশসেরা হয়ে দেশের বাইরে যেতে তো লিগ্যালিটি লাগবে। ফ্রান্স কী করল! ২০১২ তে তার বাবাকে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে তার বিদেশের পথ সুগম করল। শুধুমাত্র ছেলেটিকে নিজেদের করে রাখতে। ছেলেটিও আশাহত করেনি। ২০১৩ সালে গ্রীসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কুল দাবা প্রতিযোগিতা (অনূর্ধ্ব ১৩) তে চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর বিশ্ব জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়নশীপেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এভাবেই ফাহিম এবং পরিবারকে ফ্রান্স তার করে নিয়েছে। তার বায়োগ্রাফির উপির ‘Un Roi clandestin’ নামে বই বের হয়েছে ২০১৪ সালে। ‘ফাহিম’ নামে তার উপর একটি সিনেমাও বানানো হয়েছে। এবছরেই মনে হয় মুক্তি পাবে।

তার কথা হঠাৎ মনে হল। আচ্ছা, সে যদি বাংলাদেশি না হয়ে রোহিঙ্গা হতো, আর ফ্রান্সে না এসে বাংলাদেশে যেতো- কী হতো। এরকম এতো দূর যেতে পারতো? হতে পারতো কোনো সেক্টরে চ্যাম্পিয়ন? মনে হয় না। রহিমা আক্তারের মতো বহিষ্কার করে দেয়া হতো।
সে যদি মেধার কারণে মানুষের চোখে পড়ে যেতো, তাহলে স্তরে স্তরে লাত্থি খেয়ে ওওওওই ক্যাম্প্যের কোনায় বসে হয়তো বিড়ি ফুকতো আর চুরি-বাটপারির ধান্ধা করতো।

রোহিঙ্গা খামার করে বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকার খয়রাত এনে চেটেপুটে খেতে খুউব মজা লাগে অথচ তাদের একটি মেধাবী মেয়েকে পড়ালেখার সুযোগ দেওয়ার বিরোধীতা করে আমরা খুবই দেশপ্রেম দেখায়। আজ মেয়েটিকে যদি সবাই তার আপন বোনের জায়গায় বসিয়ে বিচার করতো তাহলে বোধ করি সকলেই তার অনুভুতিটা বুঝতে পারতো।

আমি বার বার বলছি, ঐসব ঐতিহাসিক চেতনা টেতনা আসলে জাতিকে বোকা বানিয়ে, আবেগী বানিয়ে বিভক্ত রাখার মোক্ষম কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয় । যারা তরুন সমাজকে এই চেতনার গল্প শুনায় তাদের সামনে ‍তুলে ধরুন সাম্য আর মানবিকতা রক্ষায় ইসলামের, ইসলামী চেতনার গৌরব্বজ্জল ইতিহাস। তবেই মিলবে মুক্তি। ঐসব ইতিহাস আর চেতনার ভয়ে যারা আদর্শ বদল করতে চাচ্ছেন তাদের মনে রাখা উচিত, এসব চেতনা বেশি দিন টিকবে না, পাবলিক রিয়েল চরিত্র খোজা শুরু করছে, ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতি, চেতনার প্রতি এখন আর তেমন আগ্রহ নেই, বরং একরাশ ঘৃনাই ছড়াচ্ছে।