ড, শেখ শাহরিয়ার আহমেদ (সম্পাদক)- ১৫ই আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন ও আদর্শ চর্চা।
১। বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন বিশ্ব নেতা সম্পর্কে লেখা আমাদের জন্য অনেক অনেক কঠিন কাজ। তার সাধারন জীবন যাপন, জনগণের সার্বিক মুক্তির জন্য কঠিন সংগ্রাম, বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত ও বিরামহীন লড়াই, ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির মধ্য দিয়ে জনগণের রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস যেমন সহজ বা সরল নয়, তেমনি তা অত্যন্ত কঠিন না হলেও সুকঠিন। তিনি বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক থেকে সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসের নিপীড়িত-নির্যাতিত শোষিত -বঞ্চিত ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতিসমূহের ও মানুষের বিশ্ব নেতা হয়ে ওঠেন। বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত জাতিসমূহের মুক্তির সংগ্রামী হিসেবে আজও তিনি এক বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ও অনুপ্রেরণার উৎস। সমকালীন বিশ্বে উপনিবেশিকতা ও সাম্রারাজ্যবাদীযুদ্ধ বিরোধী বিশ্ব শান্তির একজন অগ্রগন্য বিশ্ব নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। জাতিসংঘের বক্তব্যে, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে , বিশ্ব শান্তি পরিষদে, কমনওয়েলথ সম্মেলনে সব জায়গায় তিনি বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকারের ও তাদের সংগ্রামের ন্যায্যতার বিষয়ে ছিলেন সোচ্ছার । জায়নবাদী ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি মানুষের পক্ষে তাঁর ও নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা বলেছেন অবলীলায় । জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি শুধু বাংলাদেশের মানুষের কথাই বলেননি, বলেছেন শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থার নির্মানে বৈষম্য মুলক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূনর্গঠনের কথা , বলেছেন সাম্রারাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান , যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে বিশ্ব সামাজের কর্তব্যের কথা। তাই এই বাঙালি বিশ্ব নেতা সম্পর্কে অধ্যয়ন সুকঠিনতো বটেই অধিকন্তু কষ্টসাধ্য । উপরে আমরা যে সব বিষয়ের অবতারণা করেছি তা আমরা তাঁরই প্রদত্ত বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্য ও বিভিন্নভাবে লেখা বইপত্র পড়ে অনুধাবন করেছি এবং করে যাচ্ছি। এটি আমাদের ধারাবাহিক পাঠক্রমেরই অংশ । কেননা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিষয়ে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে পুর্ণাঙ্গ কোন গ্রন্থ বা গবেষণামালার অভাব আমরা তীব্রভাবে অনুভব করছি। আর এ অভাব এরও পেছনেও আছে এক ইতিহাস । উনিশ পছাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে প্রতিক্রিয়াশীল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী শক্তিসমূহ ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানতো বটেই এমনকি তাঁর নাম পর্যন্ত মুছে দেয়ার র্দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আজও যে হচ্ছে না তাও নিশ্চিত নয়। তা থেকেই বাঙালির এই গর্দান উচু মহানায়ক বিষয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের কি পরিমান ভীতি তা সহজেই অনুমান করা যায়।
২. বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীণ সমাজের এক গৃহস্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা শেখ লুৎফর রহমান বৃটিশ শাসিত বাংলার নিম্ন আদালতে কর্মরত একজন চাকুরীজীবি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্নজীবনী’ থেকে তাঁর জীবনের একটি অংশের নির্ভেজাল ইতিহাস আমরা পাই। নির্ভেজাল বলছি এ কারণে যে, তিনি কোন রূপ রঙ না লাগিয়ে সোজা সাপ্টাভাবে যা সত্য তা-ই লিখেছেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের মধ্যেই তিনি বেড়ে ওঠেছিলেন। শৈশব , কৈশোর ও তারুণ্যের একটা অংশ তাঁর কেটেছে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে । তিনি তাঁর জীবনে বৃটিশ উপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে যেমন সংগ্রাম করেছেন, ঠিক একইভাবে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই অর্থে তিনি তাঁর এক জীবনে ‘বৃটিশ পতাকা’ তৎপরবর্তীতে ‘পাকিস্তানী পতাকা’র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা তলে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডে শিকার হয়েছিলেন। অধ্যাপক রংগলাল সেন লিখেছেন ‘বঙ্গবন্ধু ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে কলকাতায় তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। সুদীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি শোষণহীন, গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ’ বস্তুত কৈশোর থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুনাবলীর বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। দুরন্ত ও দুঃখী মানুষের প্রতি ভালবাসা কৈশোর বয়স থেকেই তাঁর চরিত্রের অংশ । নেতৃত্ব , কর্মের প্রতি অবিচল ও সাহসিকতার সাথে নিজের বিশ্বাস, নীতি ও যুক্তিকে প্রকাশের এবং বাস্তবায়নের বিষয়গুলো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। নিজের বাবার ফুটবল দলের সাথে নিজের বিদ্যালয়ের ফুটবল দলের দলনেতা হিসেবে কৈশোর বয়সেই তাঁর যে ভূমিকা তাতেই বুঝা যায় তিনি কেমনতর মানুষ ছিলেন। নীতি ও বিশ্বাসে অটল কিন্তু মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও মানুষের সৃজনশীল শক্তির প্রতি তার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু চরিত্রে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। আর এভাবেই টুঙ্গিপাড়ার মুজিবুর কলকাতার রাজপথে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে লিপ্ত হয়ে পড়েন। নিষ্টাবান রাজনৈতিক কর্মী , অনন্য সাধারণ কর্মদক্ষতা ও নীতি-বিশ্বাসে অটল মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, আবুল হাসেম প্রমুখ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের প্রিয় মুজিবুর সবসময়ই আদর্শ ও নীতির জন্য ভিতরে বাহিরে সংগ্রাম করেছেন। দেশভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা বুঝতে পারেন যে, তাদের প্রিয় বাংলা আরেক ঔপনিবেশিক শোষণের মধ্যে একটি উপনিবেশ হয়ে পড়েছে। তাইতো আমরা তাদের রচিত ও ১৯৪৮ সালে প্রচারিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনসাধারণ’ শীর্ষক প্রচার পুস্তিকায় দেখতে পাই পূর্ব বাংলার জনসাধারণের প্রকৃত অবস্থা এবং তাদের চিন্তাধারা। শুধু তাই নয় তাঁরই আরেক সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়রীর প্রথম খন্ডে ( ১৯৪৭-৪৮) ২৬ মার্চ ১৯৪৮ তারিখের পৃষ্ঠায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনার দালিলিক প্রমানও পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির চিন্তাভাবনা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ শুরু করে দেন দেশ বিভাগের সাথে সাথেই। শুধু তাই নয় এর জন্য সাংগঠনিক তৎপরতাও তারা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে ধাপে ধাপে যে সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন তা আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পড়ি। আর এভাবে তিনিই বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সমকালীন বিশ্বে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষ ও জাতিসমূহের এবং মুক্তিসংগ্রামের নিবেদিত প্রান শ্রেষ্ঠ নেতাদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। বস্তুত সংক্ষেপে এই মহানায়কের বাংলাদেশের জাতির পিতা থেকে বিশ্ব শান্তি ও মানুষের মুক্তির নেতা হয়ে ওঠার কর্মকা- মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ভাষায়: ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানব জাতির পথ প্রদর্শক ও মহান নেতা।’ বঙ্গবন্ধু- বিশ্ববরণ্যে বাঙালি এই মহান নেতা জন্ম গ্রহন করেছিলেন টুঙ্গিপাড়ায়, আর হত্যাকারীরা তাকে অস্ত্রের মহড়ায় কবর দিয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। আজ তিনি চিরতরে সমাহিত হয়ে আছেন তারই জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় । এই টুঙ্গিপাড়াস্থ সমাধিই এখন হয়ে উঠেছে দেশী ও বিদেশী সকল মুক্তিসংগ্রামী -মানবতাবাদী মানুষের শ্রদ্ধা ও অনুপ্রেরনার স্থল।
৩. আমরা শ্লোগানে , বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা পড়ি, শুনি ও বলে থাকি। বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম , একটি চেতনা ইত্যাদি শব্দবন্ধও ব্যবহার করি। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই যে বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শ ও চেতনার নাম। তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চেতনা এবং সেই সাথে তাঁর চিন্তাধারা বা দর্শনের মর্মবস্তু । ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন তিনি এক আদর্শ , চেতনা ও চিন্তাধারা। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাঁর চিন্তাধারা ও দর্শনের অধ্যয়নের ধরতাই কিভাবে পাওয়া যেতে পারে কিংবা শুরু করা যেতে পারে। বস্তুত বঙ্গবন্ধু প্রচলিত অর্থে কোনো দার্শনিক না হলেও তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মসূচী তথা বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চিন্তাধারাসমূহ সুস্পষ্ঠভাবে প্রতিভাত হয়েছে বলে পন্ডিত মহল মনে করেন। আর সেটাই হতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চিন্তুাধারা ও দর্শন অধ্যয়নের ধরতাই। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন যখন বলেন: ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ ও নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আজ খুবই। তাঁর আদর্শবোধের গভীরতার এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ঠ্যে আমরা আবারও অনুপ্রাণিত হব ।’ অথবা সমাজ বিজ্ঞানী রংগলাল সেন যখন লিখেন : ‘একথা বলাই বাহুল্য যে, বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুসন্ধান , অনুসরন ও অনুবীক্ষণ আজ অতি জরুরী ও প্রয়োজনীয়।’ বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্নজীবনী’ বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রদত্ত সব ভাষণসমূহ , পত্র পত্রিকায় ও গণমাধ্যমে প্রদত্ত বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারসমূহ এবং সর্বোপরি তাঁর গৃহিত নানাবিধ কর্মসূচী ও পদক্ষেপসমূহ নি:সন্দেহে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও দর্শন চর্চার বা অধ্যয়নের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে । আমাদের মতে তাঁর চিন্তাধারা ও দর্শন অধ্যয়নে এই হলো মৌলিক প্রস্থানবিন্দু, অন্তত সঠিকভাবে তাঁর চিন্তাধারা বুঝার ক্ষেত্রে আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে এবং এভাবেই তাঁর সাথে বুঝাপড়া সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে । অর্থাৎ এভাবেই আমরা শুরু করতে পারি এবং সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুঝে নিতে পারি। প্রচলিত অর্থের দার্শনিকতার সংজ্ঞার বাহিরে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার ও দর্শনের চর্চা করার যে প্রয়োজনীয়তা সমাজ বাস্তবতায় জরুরী হয়ে পড়েছে বলে পন্ডিত মহল বলছেন তার সমাধান সুত্রও এভাবেই পেতে পারি। আর সেই জন্য প্রয়োজন শ্লোগান সর্বস্বতা ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গভীর অধ্যয়ন এবং তাঁর আদর্শকে ধারণ করে মানুষের কল্যাণ ও সামগ্রীক মুক্তির সংগ্রামে অবিচলভাবে কাজ করা। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও দর্শন চর্চা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে ‘অধ্যয়ন চক্র’ অথবা ‘ পাঠচক্র’ অথবা ‘গবেষণা চক্র’ অথবা ‘প্রশিক্ষণ চক্র’ বিস্তৃত করে দেয়া। কেননা দীর্ঘ সামারিক জান্তাদের সময়ে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে আমাদের প্রজন্মকে বিদ্যায়তনিক ও প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার মেহনতি-শোষিত-বঞ্চিত মানুষ তাদের কাছেও ‘অধ্যয়ন চক্র’ ‘পাঠ চক্র’ বা ‘প্রশিক্ষণ চক্র’ ইত্যাদির মাধমে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও দর্শনকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
৪. উনিশ পছাত্তর সালের ১৫ আগস্ট স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। বাঙালির ইতিহাসে এই দিনটি দূর্ভাগ্যের ও কলঙ্কিত একটি দিন। আগস্ট মাস আমাদের জাতীয় জীবনে শোকের মাস। বিশ্ব ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা- নিমর্মতার নজির হিসেবে চিহ্নিত । কিন্তু খুনিরা সেই দিন বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করলেও এর ষড়যন্ত্রের বিস্তার দীর্ঘ। যারা এ বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করছেন তাদের মতে, এই ষড়যন্ত্র শুরু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই । ১৯৭১’এ পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি সমূহের দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হয়। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রকারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কারাগারে তাঁর চার সহযোদ্ধাকেও হত্যা করে বাংলাদেশের অগ্রসর চেতনার বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছে। সামরিক বাহিনীর বহিস্কৃত , বিপথগামী জুনিয়র অফিসারদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি করা হলেও এদের পেছনের শক্তিসমূহ ধীরে ধীরে উম্মেচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিচারের মাধ্যমে খুনিদের সর্বোচ্চ সাঁজা ঘোষিত হয়েছে এবং গুটি কয়েকের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিস্কার , আর তা হলো বিচারিক আদালতে খুনিদের বিচার হয়েছে সত্য , তবে খুনিদের পেছনে ষড়যন্ত্রকারী মদদকারী দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের চিহ্নিত করাও জরুরী কর্তব্য । এটা ইতিহাসের দাবি, বাংলাদেশ তথা বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও ন্যায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার প্রগতিশীল বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। আর এ কাজটি করা হলে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর এর পূর্বাপর সামগ্রীক একটি চিত্র আমরা পেতে পারি । যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অগ্রসর বিকাশের পথে চ্যালেঞ্জ সমূহ ও করণীয় নির্ধারণে সহায়ক হবে। আর বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ১৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনাবলীর বিস্তৃত ক্যানভাসের নির্মোহ বিশ্লেষনের মধ্যে থেকেও পাওয়া যাবে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা।
৫. উনিশ পছাত্তর সালের ১৫ আগস্ট স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিনটি জাতীয়ভাবে শোক দিবস হিসেবে আমরা পালন করি। আমরা বক্তৃতায় শুনি , লেখায় পড়ি ‘শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত’ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে? ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি জাতি কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে পড়েছিল। তার ধরাবাহিতকায় ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে ষড়যন্ত্রকারী খুনিচক্র বাংলাদেশের সামগ্রিক মুক্তির সংগ্রামের আদর্শের নেতৃত্বের বিনাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা যখন শুনি ‘এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব বাংলার ঘরে’ শ্লোগানে গুটিকয়েক তরুণের কামানের ঝনঝঞ্চানির মধ্যেও রাজপথ কাপানো মিছিলের কথা; তখনতো আমাদের শোক শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার সূচনা । শ্লোগানের মর্মার্থ আমাদের বুঝিয়ে দেয় ষড়যন্ত্রকারীরা আর খুনিরা যারাই হও ‘লক্ষ লক্ষ মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’। অপরদিকে বিশ্বাসঘাতক সামরিক জান্তা খুনি প্রতিক্রিয়াশীলদের তান্ডবলীলার মধ্যেও যখন বাংলার তরুণেরা প্রচার পত্র বিলি করে খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; তখনতো বুঝতে পারা যায় মুজিব এর বাঙালিকে ‘ দাবায়া রাখা যাবে না’। বাঙালির প্রগতির ঝাণ্ডা হাতে সদ্য বিধবা এক মহিলা তাঁর ছোট এক শিশুপুত্রকে সাথে নিয়ে যখন রাজপথে প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে হুংকার দেন, বঙ্গবন্ধু ও ৭১’র চেতনা ও আদর্শ পুন:রুদ্ধারে বাংলার পথে প্রান্তরে উল্কার মতো ছুটে বেড়ান, তখনতো শোকের মাতাম এর সম্মিলনের শক্তিতে আতঙ্কিত ষড়যন্ত্রকারী ও খুনিরা। সেভাবেই ১৯৭৫ সালের তারুণ্যের শ্লোগান বাস্তবে রূপায়িত হয়ে যায়। এক মুজিবের লোকান্তরে লক্ষ লক্ষ মুজিব বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে । সেই কালে হয়ত তাদের পক্ষে শোকের রং ‘কালো’ রংয়ের শাড়ী কিংবা কালো কুর্তা-পাঞ্জাবী ছিল না, এক চিলতে কালো কাপড়ের শোকের প্রতীকি টুকরোও হয়ত জোগাড় করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তাদের পক্ষে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত , সেই সময়ে তাদের ইস্পাত কঠিন নির্ভেজাল শোকের শক্তি ছিল আদর্শগত চেতনা। আর সে কারণে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন ‘লক্ষ মুজিব’ । খুনি ষড়যন্ত্রকারী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে যে লড়াই মুজিব শিখিয়েছেন বাঙালিকে তার কি বিনাশ আছে ? এই হলো আদর্শের ও চেতনার শক্তি। আদর্শ ও চেতনাহীন লেভেল সর্বস্ব শোকে শক্তিমত্তা থাকতে পারে না বলে আমরা মনে করি । তাই শোককে শক্তিতে রূপান্তরের জন্য চাই আদর্শগত চেতনাকে শানিত করা; তার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম আর লড়াই। বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় তা অত্যন্ত জরুরী। কেননা পরাজিত খুনি ষড়যন্ত্রকারী শক্তি ভেতরে ও বাহিরে আজও সক্রিয়।
৬. বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু বলা বা লেখার মতো সক্ষমতা আমাদের এখনও হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে আমরা নিতান্তই পাঠক । কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় কিংবা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের কাঙ্খিত বিকাশের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন চিন্তাধারা ও দর্শন আজও দিকদর্শন। তাই তাঁর চিন্তুাধারা ও দর্শন আমাদেরই স্বার্থে গুরুত্বের সাথে চর্চা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্ব-পরিবারে হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ইতিহাসের নির্মোহ পাঠের মাধ্যমে আমাদেরকে ভিতরের-বাহিরের শত্রুকে চিহ্নিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন, ধারণ ও পরিচর্চার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষকে শোষণহীন সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ নির্মানের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ঘরে বাহিরে শত্রুর মোকাবেলা করার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ , চিন্তাধারা ও দর্শনের সাথে প্রতিনিয়ত বুঝাপড়া করা ছাড়া উপায় নেই। সেজন্যই সম্ভবত অমর্ত্য সেন বলেছেন: ‘তাঁর আদর্শবোধের গভীরতার এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ঠ্যে আমরা আবারও অনুপ্রাণিত হব ।’
ভাষান্তর, সংগৃহীত ও সংযোজিত – ডাঃ শেখ শাহরিয়ার আহমেদ (সম্পাদক-দৈনিক সমাজের কন্ঠ)