ফুটবল মাঠেও যুগে যুগে এমন কিছু জাদুকর এসেছেন। ইউটিউব ঘাটলে রোনালদিনহোর একটা ভিডিও ক্লিপ পাওয়ার কথা। সেই ক্লিপে দেখা যায়, রোনালদিনহো নাইকির বুট পড়ে বলকে শট মেরে গোলবারে লাগাচ্ছেন। বল বারে লেগে ফেরত আসার পর সেটা মাটিতে পড়তে না দিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় আবার বারে মারছেন। ইউটিউবের প্রথম মিলিয়ন বার দেখা ক্লিপ এটা। দেখলে আসলে আশ্চর্যই লাগে, কীভাবে একজন মানুষ এই কাজটা এত সুচারুভাবে করতে পারেন। বলটা যেন তার কথা শোনে। এই কারণেই রোনালদিনহোকে ‘ম্যাজিশিয়ান’ বা জাদুকর বলা হতো।

একটা সময় স্ট্যানলি ম্যাথুসকেও জাদুকর নামে অভিহিত করা হতো, বর্তমান সময়ের লিওনেল মেসিও। এই ক্ষুদে জাদুকর দিনের পর দিন দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখছেন তার ফুটবল শৈলী দিয়ে।

তবে আপনি জেনে অবাক হতে পারেন, জাদুকরের মতো কাজগুলো প্রায় প্রতিনিয়তই করতেন উনিশ শতকের শুরুর দিকে এক বাঙালি ফুটবলার। তার নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। ম্যাজিশিয়ান কিংবা জাদুকর উপাধি আরো অনেক খেলোয়াড় পেলেও সামাদের সাথে উপাধিটা নামের অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তার কবরের গায়ে লাগানো নামফলকেও ‘জাদুকর সামাদ’ই লেখা রয়েছে। আজ আমরা সেই সামাদের কিছু ঘটনাই জানার চেষ্টা করবো।

১.

খেলাটা হচ্ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাভায়, ইন্দোনেশিয়া একাদশ আর ভারতীয় একাদশের মধ্যে। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচে খেলছে দুই দলেরই তুখোড় সব খেলোয়াড়। চেষ্টা চালালেও কোনো পক্ষই গোল করতে পারছে না। ঠিক সেই সময় ভারতীয় দলের একজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের কয়েকজনকে সুন্দরভাবে কাটিয়ে শট করলেন গোলপোস্টে। কিন্তু বল বারে লেগে পোস্টের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলো।

এই ধরণের ঘটনা ফুটবল মাঠে বিরল কিছু নয়। তবে সেই খেলোয়াড়টি অবাক হয়ে পোস্টের কাছে গেলেন। যেন এমন কিছু হতে পারে, সেটা তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। এত সুন্দর করে বানিয়ে এনে এত মাপা শট বারের বাইরে যায় কিভাবে?  তার মনে হলো, কিছু একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। গোলপোস্টের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রেফারিকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করতে থাকলেন,

‘আপনি খেলা থামান, গোলপোস্টের উচ্চতা কম আছে। খেলা থামান, আমি চ্যালেঞ্জ করছি।’

রেফারিসহ বাকিরা অবাক হলেও অবাক হলেন না ভারতীয় দলের অন্যান্য সদস্যরা। কারণ, চ্যালেঞ্জ জানানো খেলোয়াড়টার প্রতি তাদের ধারণা ছিল। সবার দাবিতে রেফারি খেলা থামিয়ে ফিতা আনতে বাধ্য হলেন। পরে মেপে দেখলেন, আসলেই পোস্টের উচ্চতা দেড় ইঞ্চি কম। বাতিল করা গোলটা তখন গোল বলে গণ্য হলো।

ডাকটিকেটের স্ট্যাম্পে সামাদ; Image Source: HipStamp

নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী এই লোকটার নাম সামাদ। ভালোবেসে মানুষ তাকে ‘জাদুকর সামাদ’ নামে ডাকতো।

তার সম্পর্কে আরো অনেক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তিনি নাকি খেলতে নেমে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিতেন, আর বাদাম খেতেন।  ও হ্যাঁ, গোঁফে তা দেওয়াটাও ছিল সামাদের একটা স্বভাব। দলের অবস্থা যখন খারাপ হয়ে যেত, অথবা খেলার সময় যখন প্রায় শেষ সময়, তখন সঙ্গী খেলোয়াড় আর দর্শকদের চিৎকারে মাঠে নেমে ২/৩ টা গোল করে আবার ফিরে যেতেন আগের কাজে। গোল করা যেন তার কাছে ছিল ইচ্ছের বিষয়। জীবনে বহু ম্যাচের আগে নাকি খেলা শুরুর আগেই বলে দিয়েছেন কয়টা গোল করবেন, এবং দিনশেষে সেটাই করে ফেলেছেন।

সাধে কি তাকে আর জাদুকর ডাকা হতো?

২.

সামাদের জন্ম হয়েছিলো ১৮৯৫ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়ায়। মাত্র ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি। ফুটবল নিয়ে এতটাই মগ্ন থাকতেন যে, স্কুলে আসা যাওয়ার সময়েও পায়ে ফুটবল লেগেই থাকতো। ১২/১৩ বছর বয়স থেকেই খেলতেন পূর্ণিয়া ডিস্ট্রিক্ট টাউনের হয়ে। পূর্ণিয়াতে ফোকাস কাপের একটা ম্যাচে নাকি কিষাণগঞ্জ স্কুলের বিপক্ষে ১০টি গোলও করেছিলেন।

সামাদের সমাধি; Image Source: শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘ফুটবলের জাদুকর সামাদ’ বই থেকে প্রাপ্ত  

সামাদ প্রথম কলকাতায় খেলতে নেমেছিলেন ১৯১৩ সালে এরিয়েন্স ক্লাবের হয়ে। তবে সামাদের নাম-ডাক চারদিকে ছড়াতে থাকে, যখন তিনি কলকাতার তাজহাট ফুটবল ক্লাবে যোগ দেন। তাজহাট ক্লাবটা খুব বেশিদিন টিকতে পারেনি। এরপর সামাদ কিছুদিন কলকাতা মোহামেডান এবং মোহনবাগানের হয়েও খেলেছেন। ১৯৩৪ সালে কলকাতা মোহামেডানের হয়ে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে লিগ শিরোপা জয় করে। সেবারই প্রথম তারা ইংরেজদের কাছ থেকে লিগ শিরোপা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এরপর মোহামেডান পরপর পাঁচবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা কিনা একটা নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। মোহামেডান থেকে পরবর্তীতে সামাদ চলে যান ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) দলে। সামাদের ছেলে আবুল হোসেনও ফুটবল খেলতেন ইবিআর দলে। শেষদিকে পিতা-পুত্র একসাথেও কিছু ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন।

৩.

ক্লাব ছাড়াও ভারতীয় দলের হয়েও কিছু ম্যাচ খেলেছেন সামাদ। ১৯২৪ সালে তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন। জাতীয় দলের হয়ে তিনি বার্মা, সিলন, হংকং, চীন, জাভা, সুমাত্রা, মালয়, সিঙ্গাপুর এবং ব্রিটেনে ভ্রমণ করেছেন। চীনের বিপক্ষে একবার একটা ম্যাচে তিনি খেলতে নামেননি ইনজুরির জন্য। প্রথম অর্ধেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে যায় তার দল। ক্ষিপ্রগতির চাইনিজ খেলোয়াড়দের বিপক্ষে কিছুই করতে পারছিলেন না ভারতীয় ডিফেন্ডাররা। কিন্তু দ্বিতীয় অর্ধে সামাদ আর সহ্য করতে পারলেন না, কোচকে অনুরোধ করেন মাঠে নামাতে। কিন্তু ইনজুরড খেলোয়াড়কে মাঠে নামানোর ঝুঁকি নিতে কোচ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সামাদ প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি ১৫ মিনিটের মাঝেই ৪টি গোল করবেন। সামাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে কোচ তাকে মাঠে নামান।

সমাধিতে শ্বেতপাথরে লেখা রয়েছে ‘চিরনিদ্রায় শায়িত ফুটবল জাদুকর সামাদ’ Image Source:  শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘ফুটবলের জাদুকর সামাদ’ বই থেকে প্রাপ্ত 

মাঠে নামার তিন মিনিটের মাঝেই দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম গোলটি করে ফেললেন। পাঁচ মিনিট পরই তিনি মধ্যমাঠ থেকে শট করে সরাসরি আবারও গোল করে ফেললেন। সেই মুহূর্তে প্রকৃত বিপদটা আঁচ করতে পারলো চীনের খেলোয়াড়রা। তারা সামাদের বিপক্ষে শক্ত ডিফেন্স করতে থাকলো। কিন্তু ‘সুপারম্যান’ সামাদ অল্প সময়ের মাঝেই আরো দুটি গোল করে দলকে ৪-৩ গোলের একটা অবিস্মরণীয় জয় উপহার দেন।

সেই সময়ে প্রতিবছরই কলকাতায় ভারতীয় একাদশ আর ইংল্যান্ড দলের মাঝে একটা ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো। সেই সময়ের ইংল্যান্ড দল পুরো বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে বেড়াতো। তাদের সাথে খেলতে পারাটাই ভারতীয় দলের জন্য সৌভাগ্য বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু ১৯২৫ সালে সামাদের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড দলকেও ৪-১ গোলে হারিয়ে দেয় ভারতীয় দল। কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সেই খেলার রিপোর্ট সম্পর্কে বলা হয়েছিলো,

‘সামাদ তার অনন্য ফুটবল নৈপুণ্য দ্বারা গঙ্গার জলে যেন আগুন ধরিয়ে দিল।’

গঙ্গার জলে আগুন জ্বালানোটা যেমন অবিশ্বাস্য, ঠিক তেমনি সেই ম্যাচটাতে সামাদের পারফরম্যান্সও ছিল অবিশ্বাস্য।

৪.

সামাদ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি নিয়ে পার্বতীপুরে চলে আসেন। যদিও রেলওয়ের কোনো প্লাটফর্মে ইন্সপেক্টর পদ ছিল না, তবুও সামাদের সম্মানার্থে এই পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ১০ বছর এখানেই চাকরি করে গিয়েছেন সামাদ। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বাস করতেন রেলওয়ে কলোনিতে সামাদের জন্য বরাদ্দকৃত একটা ছোট বাংলো বাড়িতে। ১৯৫১ সালে ঢাকার মাঠেও একটা প্রদর্শনী ম্যাচে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। প্রবীণ খেলোয়াড়দের প্রদর্শনী ম্যাচে ৫৬ বছর বয়স্ক সামাদ অংশ না করলেও জার্সি পড়ে মাঠে ঘুরে দর্শকদের আনন্দ দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে এই পার্বতীপুরের বাসাতেই সামাদ অতীতের স্মৃতিচারণ করতেন। ১৯৬৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ৬৯ বছর বয়সে সামাদ ইন্তেকাল করেন।

‘সামাদ ইন্সটিটিউট, পাশে ‘সামাদ স্মৃতি শিল্পী গোষ্ঠি’; Image Source: শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘ফুটবলের জাদুকর সামাদ’ বই থেকে প্রাপ্ত 

মৃত্যুর পর অবহেলিতই ছিলেন তিনি। অবশ্য মৃত্যুর ২৫ বছর পর ১৯৮৯ সালে ৫২ হাজার টাকা খরচ করে তার উদ্দেশ্যে স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়। এছাড়া ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে সামাদের স্মরণে একটা স্মারক ডাকটিকেট এবং একটা উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করা হয়।

সামাদের স্মরণে প্রকাশিত উদ্বোধনী খাম; Image Source: Mediabd.com 

একজন স্কটিশ ফুটবল বিশারদ সামাদের খেলা দেখার পর বলেছিলেন,

‘সামাদ যদি ইউরোপিয়ান হতেন, তাহলে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হতেন।’

বিশ্বজুড়ে পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, রোনালদোরা আলো ছড়ালেও ‘জাদুকর’ নামটা কিন্তু মৃত্যুর এত বছর পরও সামাদের নামের পাশেই রয়ে গিয়েছে। হয়তো মানুষের এই ভালোবাসাটাই তার স্বীকৃতি।

 

রোয়ার বাংলা —-