দৈনিক সমাজের কন্ঠ

বাংলা নববর্ষের প্রকৃত ইতিহাস, শিক্ষা এবং আমাদের শালীনতাবোধ

ড, শেখ শাহরিয়ার আহমেদ (সম্পাদক) দৈনিক সমাজের কন্ঠ –

রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। বাঙ্গালী জাতি মেতে উঠবে পান্তা আর ইলিশ ভোগের মাধ্যমে অনাবিল উৎসবে। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ এর ইতিহাস সমাজের ও রাষ্ট্রের বেশিরভাগ লোকই ভুলতে বসেছে অথচ প্রকৃত ইতিহাস সকল বাঙ্গালীর জেনে রাখা উচিৎ

আসুন জেনে নিই বাংলা নববর্ষ এর প্রকৃত ইতিহাস:

ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মোগল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করে প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার রাজস্ব কর্মকর্তা আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।
১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। সে সময় বাংলার কৃষকরা বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীদের সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন, তখন থেকেই রাজস্ব আদায় ও ব্যবসায় বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য বাংলা বছরের পয়লা বৈশাখকে উৎসবের দিন হিসেবে পালন শুরু করেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে পয়লা বৈশাখ:
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম পার্থিব জীবনকে পরকালীন জীবনের শস্যক্ষেত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ইসলাম আনন্দ উৎসব উদযাপন করার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু তার সীমারেখা টেনে দিয়েছে। ইসলাম শান্তির কথা বলেছে, কিন্তু অশান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। ইসলাম শালীনতার কথা বলেছে, কিন্তু অশালীনতা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। এক কথায়, মানুষের অকল্যাণ হয় এমন প্রতিটি কাজ থেকেই বিরত থাকতে বলেছে ইসলাম।
বাংলাদেশে প্রতি বছর মহা ধুমধামে পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, নববর্ষের উৎসব উদযাপনের এই দিনে ইসলামী রীতি উপেক্ষা করে নামধারী কিছু মুসলিম বিজাতীয় অপসংস্কৃতির অনুসরণ করে যাচ্ছে। তারা শাখা-সিঁদুরের রঙে (সাদা ও লাল) পোশাক পরিধান, বিয়ের মিথ্যা সাজে দম্পত্তি সাজিয়ে বর-কনের শোভাযাত্রা, মূর্তির (কুমির, পেঁচা, বাঘ ইত্যাদিও মুখোশ) প্রদর্শনী, উল্কি আঁকা, মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করছে। নববর্ষ উদযাপনে তাদের আনন্দ ফুর্তি ক্রমেই যেন সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা:
নববর্ষ উদযাপনকারী অনেকেই দিবসটিকে কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক বলে মনে করে থাকেন। তাদের ধারণা ‘নতুন বছর কল্যাণ বয়ে আনে, দূর করে যাবতীয় পুরনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি’- এ ধরনের কোনো তত্ত্ব ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না। মূলত নতুন বছরের সাথে কল্যাণ শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি পূজারী মানুষের কুসংস্কারচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণারই বহিঃপ্রকাশ।

পরিশেষে একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আমি বলবো –
পহেলা বৈশাখ বাংলার জনগন তথা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির কাছে একটি উৎসবের দিন হিসেবে পালনীয় তবে অবশ্যই এই দিনটি উদযাপিত হোক ইসলামে নির্দেশিত আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে ও তাকওয়ার অনুভূতি নিয়ে। ‍সুতরাং সকল শালীনতা বজায় রেখে ও ধর্মীও নির্দেশনামতে আবর্তিত হোক আমাদের পহেলা বৈশাখের উৎসব।