ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ সিংহাসনে নতুন বসলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা। চারদিকে নানার আমল থেকেই দানা বাঁধতে থাকা ষড়যন্ত্রগুলো যেন আরও ডালপালা মেলতে লাগলো সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতা আরোহনের পর, সিরাজের ভাগ্যাকাশে দেখা দিতে লাগলো দুর্যোগের ঘনঘটা। সিরাজদ্দৌলা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলেন ঘর সামলানোর। শুরু হলো বড় খালা ঘসেটি বেগমকে দিয়ে। কারণ, তিনি কোনোভাবেই সিরাজকে মেনে নিতে পারছিলেন না। তার মতে, সিংহাসনের জন্য উপযুক্ত ছিলেন কেবলমাত্র মেঝ বোন মায়মুন নেছার ছেলে শওকত জঙ্গ। ওদিকে সিরাজ উদ্ধত, অশান্তি সৃষ্টিকারী, তাকে (ঘসেটি বেগম) সম্মান করে না, নেই মুখের লাগাম আর শিষ্টাচারও।
ঘসেটি বেগমের মতিঝিল প্রাসাদটি ছিল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। রাজবল্লভের মাধ্যমে ঢাকা থেকে আদায়কৃত বিপুল রাজস্ব দিয়ে তিনি প্রাসাদটি এতটাই জাঁকজমকের সাথে সাজিয়েছিলেন যে, নবাবের প্রাসাদও যেন জৌলুসের দিক দিয়ে এর কাছে হার মানতো। আবার কিছুটা নির্জন স্থানে থাকায় সিরাজ বিরোধীরা এখানে এসে শলাপরামর্শের সুবিধাটাও পেত।
মতিঝিল প্রাসাদের অভিমুখে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছিলো সিরাজের বাহিনী। সেনাদের বলা ছিল, ঘসেটি বেগমের সাথে যেন কোনোরকম অসৌজন্যমূলক আচরণ করা না হয়। কিন্তু, তিনি যদি স্বেচ্ছায় আসতে না চান তবে বল প্রয়োগের অনুমতি অবশ্য দিয়েছিলেন সিরাজ।
যথাসময়ে মতিঝিল প্রাসাদের সামনে গিয়ে থামলো সিরাজ-বাহিনী। ধীরে ধীরে ঘেরাও হয়ে গেলো প্রাসাদ। চারদিকেই একটা থমথমে ভাব, এই বুঝি যুদ্ধ লেগে যায় ভাগনে আর খালার বাহিনীর মাঝে। খবর গেলো ঘসেটি বেগমের কাছে, তাকে বন্দী করা হবে। এক নবাবের কন্যা তিনি (নবাব আলিবর্দী খাঁ), ফলে নবাবী বৈশিষ্ট্য তিনিই বা কম দেখাবেন কেন! তাই তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিরোধের।
ওদিকে ঘসেটি বেগমের খাস মুন্সির নাম ছিল মীর নজর আলী। অর্থ দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তারই। তিনি বুঝলেন, সিরাজ-বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘসেটি-বাহিনী কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারবে না। তাসের ঘরের মতোই ভেঙে যাবে তাদের প্রতিরোধের যাবতীয় প্রচেষ্টা। ফলে অযথা সাধের প্রাণটা হারাতে চাইলেন না তিনি। চুপ করে কিছু অর্থকড়ি নিজে রেখে বাকিগুলো ঘসেটি বেগমের সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সবাইকেই উপদেশ দিলেন পালিয়ে যেতে! ঘসেটি বেগমের মূল্যবান অলঙ্কারাদি ও নগদ অর্থ এভাবেই হাতবদল হয়ে গেলো, আর পতনও ঘটলো মতিঝিল প্রাসাদের।
রাতের আঁধারে ঘসেটি বেগমকে একটি বজরা নৌকায় করে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার পথে, উদ্দেশ্য তাকে জিঞ্জিরার প্রাসাদে বন্দী করে রাখা। অবশ্য তার সেবা-যত্ন ও দেখাশোনায় কোনোরকম ত্রুটি যাতে না হয় সেজন্যও নির্দেশ দেয়া হয় তৎকালীন ঢাকার নায়েবে নাজিম জেসারত খাঁকে।
বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের ছেলে মিরন চাইছিলেন নবাব আলিবর্দীর সর্বশেষ জীবিত দুই তনয়া ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে (সিরাজদ্দৌলার মা) দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে। এজন্য তিনি দুজন লোক পাঠিয়েছিলেন জেসারত খাঁর উদ্দেশ্যে, যাতে করে তিনি এ বিষয়ে একটি ব্যবস্থা নেন। কিন্তু জেসারত খাঁর আবার নবাব আলিবর্দীর প্রতি ছিল কৃতজ্ঞতার সুদীর্ঘ ইতিহাস। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ভারতবর্ষে আসলেও তেমন সুবিধা করতে না পেয়ে ভগ্নমনোরথে রাস্তার পাশেই মাথা গোজার ঠাই করে নেন তিনি, শারীরিকভাবেও ছিলেন বেশ অসুস্থ। সেখান থেকে নবাব আলিবর্দী জেসারতকে নিজ প্রাসাদে এনে আশ্রয় দেন। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। নিজের কাছে রেখেই তাকে রাজকার্য শেখাতে থাকেন। পরে নিজ গুণে কালক্রমে ঢাকার নায়েবে নাজিম হন জেসারত খাঁ। তাই আলিবর্দীর কোনো তনয়ার প্রতিই এতটা নির্মম হতে পারেননি তিনি, ফিরিয়ে দিলেন মিরনের দুই দূতকে।
এতে করে মিরন বুঝে গেলেন যে, জেসারত খাঁ তার কিংবা তার বাবার মতো নেমকহারামি করার মানুষ না! তাই তিনি নতুন করে দায়িত্ব দিলেন তার বিশ্বস্ত অনুচর আসফ খাঁকে। মিশন সেই আগেরটাই- ঘসেটি ও আমেনা বেগমের বিশ্বাসভাজন হয়ে তাদের খতম করে দেয়া।
অল্প সময়ের মাঝে দুই বোনেরই আস্থার পাত্র হয়ে যান আসফ। বিশেষ করে ঘসেটি বেগমকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে, আসলে তাকে নিতেই ঢাকায় এসেছেন আসফ। কারণ, সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যূত করতে তার অবদানের কথা ভুলে যাননি মীর জাফর। তাই তাকে মুর্শিদাবাদে এনে সম্মানীত করতে চান তিনি। জাঁকজমকে পরিপূর্ণ মতিঝিল প্রাসাদ আবারও ঘসেটি বেগমের হাতে তুলে দিতে চান। ফলে মুর্শিদাবাদের ফিরে যেতে ঘসেটি বেগমের আর তর সইছিল না।
ওদিকে আমেনা বেগমের রাজি হওয়ার কারণ ছিল ভিন্ন। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি মুর্শিদাবাদের খোশবাগে পুত্র সিরাজের কবর জিয়ারতের অনুমতি পেয়েছেন। কবর জিয়ারত শেষে আবারও তাকে এখানে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হবে।
অবশেষে সময়-সুযোগমতো একদিন দুই বোনকে রাতে এক বজরায় দুটো আলাদা রুমে তুলে দেয়া হয়। তাদের কেউই একে অপরের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতেন না। পাশে ছিল আরেকটি বজরা। গভীর রাতে দুই বোনের বজরা ছেড়ে মাঝিরা চলে গেলো অন্য বজরায়। কেন?
দুই বোন যে বজরায় করে যাচ্ছিলো তা বানানো হয়েছিল বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। এর নিচের দিকে কয়েকটি বড় ছিদ্র করে সেগুলো খিল দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। মাঝিরা অন্য নৌকায় যাওয়ামাত্রই আসফ খিলগুলো খুলে ফেলেন। ফলে নৌকায় খুব দ্রুত পানি ঢুকে যেতে শুরু করে।
দু’বোন তখন বুঝতে পারেন যে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আমেনা বেগম প্রাণভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল সৃষ্টিকর্তার কাছে মিরনের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি চেয়ে দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন,
“হে আল্লাহ, তুমি মিরনের অপরাধী মস্তকের উপর বিনা মেঘে বজ্রপাত নিক্ষেপ করে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার দিও।”
“মীর জাফর সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করায় ও সিরাজ তা জানতে পেরে পদচ্যুত করেছিল তাকে। ঐ দুঃসময়ে আমি মীর জাফরকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি। মীর জাফরের কোনো ক্ষতি তো আমি করিনি।”