চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি –
এলাকাবাসী জানান, উৎসবমূখর পরিবেশ ও বাহারি সাজে সজ্জিত হয়েছে যশোরের চৌগাছার ঐতিহ্যবাহী বলুহ মেলা প্রাঙ্গণ। ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার বলুহ দেওয়ানের মাজার শরীফকে ঘিরে যশোর জেলার সীমান্তবর্তী চৌগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদের তীরে হাজরাখানা গ্রামে বসে এই মেলা। এ মেলাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিণত হয়।
গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদের পাড়ে উচু ঢিবির উপর এ অঞ্চলের বিখ্যাত পীর বলুহ দেওয়ানের মাজার। আশপাশে রয়েছে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে আম, কাঠাল, বাঁশঝাড় বিস্তৃত। গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসার উৎসবে মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। মেলার পরিপূর্ণতায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে বয়ে আনে হাসি আনন্দের ফোয়ারা। এই বলুহ মেলা উপলক্ষে পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে ব্যস্ততার ধুম পড়ে যায়। মেলার এক সপ্তাহ আগে থেকেই দেশ-দেশান্তর থেকে হাজির হয় ফেরিওয়ালা, দোকানী ও পসারিরা। এবার মেলা ১৫ দিন চলবে বলে মেলা কমিটি জানিয়েছে।
হাজরাখানা, পেটভরা, টেঙ্গুরপুর, বাটিকামারি, বুন্দলীতলা, নারায়নপুর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আনন্দের ফোয়ারা লক্ষ করা গেছে। কারণ এই এলাকার মেয়ে এবং জামাইরা ঈদ বা পূজা পার্বনে তেমনভাবে শশুর বাড়িতে আসেন না। শুধুমাত্র প্রতি বছর বলুহ মেলা শুরু হলে তারা বেড়াতে আসেন। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের রীতি চালু রয়েছে। এলাকার মানুষ বরাবরই মেলাকে তিনটি ভাগে ব্যাখ্যা করতে অভ্যস্ত। প্রথম দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার হয় মেলাটি সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বুধবার হয় মহিলাদের মেলা। আর বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী দিনগুলো হয় ভাঙা বাজার। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন ওই নিয়ম তেমন মানা হয় না। এখন প্রতিদিনই সকলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা সাজিয়েছেন। নাগরদোলা, শিশুদের ট্রেন, যাদু, সার্কাস, দোলনাসহ নানান বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে এই মেলায়। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় ১৫০০ বিভিন্ন রকমের দোকান।
মেলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এস এম হাবিবুর রহমান জানান, মেলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। লোকজ সংস্কৃতিতে এই মেলা যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছে। আমরা শান্তি শৃঙ্খলার মাধ্যমে মেলাটি পরিচালনা করছি।
এ বিষয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ রিফাত খান রাজিব জানান, মেলায় যাতে আইন শৃঙ্খলার অবনতি না হয় সে সেক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি আনছার ভিডিপি ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদুল ইসলাম জানান, মেলায় কোনোরকম অশ্লীল নাচ, গান, জুয়া, লটারি পরিবেশন করতে দেয়া হবে না। গ্রামীণ পরিবেশে এই মেলার গুরুত্ব রয়েছে অত্র এলাকায়। তাই কোনো রকম অনিয়ম যাতে না হয় সেদিকে আমরা নজর রাখব।
হাজরাখানা গ্রামের বাবুল আক্তর জানান, যাকে ঘিরে এই মেলার সৃষ্টি তার সম্পর্কে হাজারও কিংবদন্তী বিদ্যমান। যা এখোনো লোক মুকে প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, পীর বলুহ দেওয়ান অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। লোক মুখে শোনা যায় তিনি যা বলতেন তাই হতো। কিন্তু তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত ছিল রহস্যের জালে আবৃত।
তিনি বলেন, যাত্রাপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বলুহ দেওয়ান। তার পিতার নাম ছুটি বিশ্বাস। তবে জন্মকাল সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য আজও পাওয়া যায়নি।
এ অঞ্চলের বয়স্কদের অনুমান তিনি ৩/৪’শ বছর পূর্বে জন্মেছিলেন। তার কিংবদন্তী সম্পর্কে জানা যায় বলুহর বয়স যখন ১০/১২ বছর তখন একদিন তার পিতার কাছে বলেন যে মাঠে গরু চরাতে যাবে। পিতার অনুমতি পেয়ে সে গরু চরাতে যান ব্যাদন বিলের মাঠে। গরুগুলি লোকের ক্ষেতের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে মনের আনন্দে বসে থাকে। জমির মালিকরা গরুগুলিকে খোয়াড়ে দেবার জন্য ধরতে যায়। এ সময় বলুহ সমস্ত গরু বক বানিয়ে গাছে বসিয়ে রাখেন। এ ছাড়া খেঁজুর রসের চুলোয় পা ঢুকিয়ে দিলেও তাঁর পা না পুড়ে যাওয়া, সরিষার গাদার (স্তুপ) আগুন ধরিয়ে দিলেও সরিষা সব ঠিকঠাক থাকাসহ নানান কিংবদন্তী কথা প্রচলিত আছে।
পেটভরা গ্রামের শিল্পী আব্দুল গনি বলেন, বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার সূত্রপাত ঘটলে ধীরে ধীরে বলুহ দেওয়ানের কাছে মানুষ জমায়েত হতে থাকে। অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর হিসেবে আখ্যা পান। লোকজন বিভিন্ন রোগের মানত করে এবং প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার তার মাজারে মানত অর্থাৎ গরু, ছাগল, হাস, মুরগি, নারকেল প্রভৃতি জিনিস দিয়ে যায়। এভাবে বছরের পর বছর পাড়ি দেয় বলুহ মেলা।