দৈনিক সমাজের কন্ঠ

সাংবাদিকরাই ভিলেন, সাংবাদিকরাই হিরো

ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ সাংবাদিকরাই ভিলেন, সাংবাদিকরাই হিরো। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার ও হামলা মামলার স্বীকার। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার। সমাজের সবচেয়ে চক্ষুশূল পেশাটির নাম সাংবাদিকতা। বেশির ভাগ শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেই সাংবাদিকরা সমাদৃত নয়। পুলিশের শত্রু সাংবাদিক। কারণ পুলিশের সব অপকর্ম তুলে ধরে সাংবাদিকরা। রাজনীতিবিদরা সাংবাদিকদের তোষামোদ করলেও মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই ক্ষোভ ঝারেন। কারণ তাদের বহুমুখী চরিত্র দৃষ্টিকটুভাবে ফুটিয়ে তোলেন সাংবাদিকরা। চিকিৎসকদের অনেক বড় ‘শত্রু’ সাংবাদিক। কারণ তাদের হঠকারী আচরণ এবং গলাকাটা মুনাফার বিষয়টি সাংবাদিকরাই তুলে ধরেন। সরকারি আমলাদের অনেক দুর্বলতা সাংবাদিকদের জানা। মাঝে মাঝে কিছু তুলেও ধরেন। এজন্য তারাও সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়েন। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সাংবাদিকরা শুধুই নেতিবাচক রিপোর্ট করে তাদের ব্যবসায় বিঘœ ঘটায়। সাংবাদিকদের কারণে অতিরিক্ত মুনাফা ও মজুদদারি করা যায় না। সমাজের দুর্নীতিবাজ, অসৎ, সন্ত্রাসী ও মাফিয়াদের অভয়ারণ্যে মূল প্রতিবন্ধকতাই সাংবাদিকরা। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারাও সাংবাদিকদের দুই চোখে দেখতে পারে না। সরকারি দলের কাছে (যে দলই ক্ষমতায় থাকুক) সাংবাদিক বা গণমাধ্যম কখনোই সমাদৃত নয়। কারণ তাদের অপরাধ, সরকারের ভালো ভালো ৯০টি দিক না দেখে ১০টি খারাপ দিকই জাতির সামনে তুলে ধরেন। এজন্য সব সরকারের আমলেই সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সরকার এবং সরকারি দলের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। আবার বিরোধী দলও সাংবাদিকদের পছন্দ করে না; ভাবে সাংবাদিকরা সরকারের দালাল। আমাদের প্রচারটা সেভাবে দিচ্ছে না। এভাবে সমাজের বেশির ভাগ শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সাংবাদিকরা নিন্দার পাত্র। সাংবাদিকরা যে একদম ধোয়া তুলসি পাতা সেটা বলছি না। তবে তাদের প্রতি যে হারে সবার ক্ষোভ ও নিন্দা বর্ষিত হয় তা দেখে মাঝে মাঝে ভাবি সত্যিই কি তারা এতোটা অপরাধী! তবে মজার ব্যাপার হলো, সাংবাদিকরা যতই নিন্দার পাত্র হোক মোটামুটি সবাই কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকদের কাছে ‘ধরা’ খাওয়া। পদোন্নতির জন্য ভালো কাজের প্রচার লাগবে, পুলিশ অফিসার বা সরকারি আমলারা দ্বারস্থ হন সেই সাংবাদিকের। রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে চান, সাংবাদিকদের সাপোর্ট লাগবেই। কোনো ভালো কাজের প্রচার কিংবা সমাজের কোনো অনাচারের বিরোধিতা করতে চান আশ্রয় এই সাংবাদিকেরাই। মিডিয়া ছাড়া সরকার যেন অচল। অসদাচরণের কারণে একটি মাত্র সংস্থা বা বিভাগের খবর বয়কটের হুমকি দিলে সংশ্লিষ্টদের গলার পানি শুকিয়ে যায়। আর বিরোধী দল, তাদের মূল পুঁজিই মিডিয়া। কোনো কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মিডিয়া জিইয়ে রেখেছে বলেও প্রচার আছে। মিডিয়া কাভারেজের প্রতি লালায়িত না এমন কোনো দল বা সংগঠন পাওয়া মুশকিল। কিন্তু তাদের সবার অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু মিডিয়া, সবার ক্ষোভের মূল টার্গেট সাংবাদিকরা। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে এখনকার সাংবাদিকতা পূর্বের ঐতিহ্য অনেকটা হারিয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা শুধু সাংবাদিকতায় নয়, প্রতিটি শ্রেণি-পেশায় এই অধঃপতন এসেছে। তা সত্ত্বেও সবখানেই ভালো-মন্দ উভয়টিই আছে। ঢালাওভাবে কোনো শ্রেণি-পেশা বা গোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা কখনও সমীচীন নয়। পুলিশ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, আইনজীবী কোন পেশাটি এমন আছে যেখানে শতভাগ স্বচ্ছতা রয়েছে। সবখানেই অধঃপতন এসেছে, সবখানেই নৈতিকতায় ধস নেমেছে। তারপরও প্রতিটি পেশাতেই এখনও ভালো মানুষের উপস্থিতি আছে। যদিও সেই সংখ্যাটা অনেক কম। সাংবাদিকতার নামেও হয়ত অনেক অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। কিন্তু তাই বলে সব সাংবাদিক অনৈতিক? সব সাংবাদিক দালাল? সব সাংবাদিক টাকা খায়? সমাজের যে কেউ সাংবাদিকদের প্রতি কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হলেই তাদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ে। পুরো সাংবাদিক সমাজ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে বসে। এটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। একবার কি ভেবে দেখেছেন, সাংবাদিকরা কত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন? সবচেয়ে অনিশ্চয়তার একটি পেশা সাংবাদিকতা। এটি এমন একটি পেশা যাদের শত্রু তৈরি হয় পাইকারি হারে। কারও পক্ষে ১০টি রিপোর্ট করার পর একটি রিপোর্টে হয়ত কোনো সমালোচনা বা নেতিবাচক কিছু এসেছে। এতেই ওই ব্যক্তি ক্ষেপে গেলেন সাংবাদিকের ওপর। সেই ব্যক্তিটি যদি হন সমাজের প্রতিষ্ঠিত কেউ কিংবা ক্ষমতাধর তাহলে তো ওই সাংবাদিকের জীবনের হুমকিও রয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতি বছর অসংখ্য সংবাদকর্মী প্রাণ হারান। যেখানেই সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যায়-অবিচার, অসততা-দুর্নীতি সেখানেই ছুটে যান সাংবাদিকরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুলে আনেন সত্যটা। আপনাকে প্রকৃত তত্যটা দিতে, আরও বেশি খবরে সমৃদ্ধ করতে নিরলস শ্রম দিয়ে যান প্রতিটি সংবাদকর্মী। সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। আরাম-আয়েশ তাদের জীবনে খুব কমই জায়গা পায়। পেশাগত কারণে তাদের ছুটে চলতে হয় অবিরাম। রাস্তায় চলছে সংঘাত-সংঘর্ষ, আপনি হয়ত ওইদিন ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বাসা থেকে বেরই হবেন না। চোখ রাখবেন টিভির স্ক্রিনে, অনলাইন পত্রিকার পাতায়; কান পাতবেন এফএম রেডিওতে। কিন্তু সাংবাদিকও যদি আপনার মতো ঘরে বসে থাকেন, তাহলে কী হবে? আপনি কি ঘরে বসে সেই তথ্যগুলো পাবেন? কোথাও বড়ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা গেল, আপনি হয়ত ভয়ে এর আশপাশেও গেলেন না। কিন্তু সাংবাদিকের সব ভয়কে জয় করে সেখানে ছুটে যেতে হবে। তুলে আনতে হবে প্রকৃত সত্যটা। একজন সাংবাদিক জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যে সত্যটা তুলে ধরেন, যে চিত্রটা আপনার সামনে উপস্থাপন করেন সেটা দ্বারা আপনি সমৃদ্ধ হন, উপকৃত হন; আবার সুযোগ পেলেই সেই সাংবাদিকের প্রতি গালি ছুড়েন-এটা কত বড় অবিচার! সাংবাদিকতার মান, নৈতিকতার দণ্ড নিম্নমুখী সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু এখনও সমাজে আশার যে প্রদীপটি দূরআকাশে মিটিমিটি করে জ¦লছে সেটার পেছনে মূল অবদান সাংবাদিকদের। প্রতিদিন শত শত মিডিয়া সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরছে। সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সচেতন করার জন্য প্রতিদিনই মিডিয়া কিছু না কিছু দিচ্ছে। আগামী প্রজন্মকে।

 

Courtesy – অভয়নগরের বাণী