শিকদার খালিদ, যশোর থেকেঃ এখন পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করতে যশোরের যাত্রীদের অতিরিক্ত অন্তত ৩০ কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিতে হচ্ছে; কিন্তু নড়াইলের কালনা সেতু চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে দূরত্ব কমে যাবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সেদিকেই তাকিয়ে আছেন যশোরের পরিবহন মালিক ও যাত্রীরা।
পদ্মা সেতু চালুর পর অধিকাংশ গাড়িই দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট হয়েই রাজধানীর গাবতলীতে প্রবেশ করছে। যাত্রীদের ‘শখ মেটাতে’ কিছু গাড়ি পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে রাজধানীর সায়দাবাদে আসছে।
যশোর বাস মালিক সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান বাবলু বলেন, “পদ্মা সেতু দিয়ে বাস চলাচল করলে জ্বালানি খরচ কমবে। সোমবার থেকে কিছু পরিবহন পদ্মা সেতু দিয়ে ফরিদপুর হয়ে চলাচল শুরু করছে। কালনা সেতু চালু হলে পূর্ণাঙ্গভাবে সবাই চলাচল করবে।”
বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, “পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বেশ কিছু যাত্রী ওই পথে ঢাকায় যেতে চাইছেন। সে কারণে দূরত্ব কিছু বেশি হলেও সোমবার থেকে কিছু পরিবহণ পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। এগুলো ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে।
“যাত্রীদের শখ মেটাতে দূরত্ব বেশি হলেও কাজটি করা হচ্ছে।”
যশোর থেকে যাত্রীবাহী বাসগুলো সাধারণত মাগুরা-ফরিদপুর-রাজবাড়ী হয়ে দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে ফেরি পার হয়। তারপর মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-সাভার হয়ে ঢাকার গাবতলীতে আসে। এ পথের দূরত্ব প্রায় ২৬২ কিলোমিটার। ভাড়া যাত্রীপ্রতি ৭৫০ টাকা।
পদ্মা সেতু চালুর আগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে সময়ক্ষেপণ সাপেক্ষে এ পথে যাতায়াতে যাত্রীদের সাধারণ সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগত। এখন যেহেতু ঘাটে কোনো জ্যাম নেই, ভীড় নেই তাই বাসগুলো সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই আসা-যাওয়া করতে পারছে বলে পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীরা জানিয়েছেন।
ফেরি পাশ কাটিয়ে এখন যারা পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করছেন তাদের আরও অতিরিক্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেশি পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এসব গাড়ি যশোর-মাগুরা-ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা দিয়ে পদ্মা সেতুতে প্রবেশ করে।
পরে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে রাজধানীর সায়দাবাদে আসছে গাড়িগুলো। সেক্ষেত্রে যশোর থেকে ঢাকা দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৯০ কিলোমিটার।
সোহাগ পরিবহনের যশোরের ব্যবস্থাপক পলাশ কুমার ঘোষ বলেন, “সোমবার থেকে চারটি করে গাড়ি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি নন-এসি ও তিনটি এসি বাস চলছে।”
“বেনাপোল থেকে যশোর হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা দিয়ে পদ্মা সেতু পার হচ্ছে পরিবহনগুলো। কেননা নড়াইলের মধুমতি নদীর উপর কালনা সেতু চালু না হওয়ায় এই বিকল্প ব্যবস্থা।“
ভাড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে পলাশ কুমার ঘোষ বলেন, যশোর থেকে নন-এসিতে জনপ্রতি ৮৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
নড়াইলের কালনা সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। যশোর থেকে গাড়িগুলো বেরিয়ে কালনা সেতু পেরিয়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি দিয়ে খুলনার পথ ধরে পদ্মা সেতুতে উঠবে। এই পথে যশোর থেকে রাজধানীর দূরত্ব দাঁড়াবে ১৮৭ কিলোমিটারের মতো। অর্থাৎ আগের চেয়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার কম।
যশোরের ঈগল পরিবহনের সত্ত্বাধিকারী পবিত্র কাপুড়িয়া বলেন, “আমাদের নন-এসি পরিবহনগুলো নড়াইল হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে। আপাতত সাড়ে ৫০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।”
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, “আগামী সেপ্টেম্বর মাসে কালনা সেতুর উদ্বোধন হবে। ততোদিন যশোর থেকে মাগুরা হয়ে ফরিদপুর দিয়ে শরীয়তপুরের মাওয়া ঘাটে যেতে পারবে।”
বাংলাদেশ পরিবহণ সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে অন্তত ছয় জেলার মানুষের ঢাকায় যাতায়াতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে।
“একমাত্র যশোর জেলার মানুষ সুবিধা পাবে নড়াইলের কালনা ব্রিজ চালু হলে। সে ক্ষেত্রে যশোর থেকে ঢাকার গুলিস্তানের দূরত্ব হবে ১৮৭ কিলোমিটার। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ কমবে।”
তখন হয়তো সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-যশোর যাতায়াত করা যাবে।
পদ্মা সেতু চালুর পর শশব্যস্ত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ এখন অনেকটাই ঝামেলাহীন; আগে যেখানে ফেরির জন্য গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত, রোববার দেখা গেল ফেরি অপেক্ষায় ছিল গাড়ির জন্য।
তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে যানবাহনের চাপ না থাকায় ফেরি ঘাটের ভোগান্তি কমে আসবে, হয়তো থাকবেই না বলে মনে করেন শ্রমিকনেতা মিঠু।
তিনি আরও বলেন, “সেক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর প্রভাবে এ পথেও রাজধানীতে যাতায়াতের সময় অনেক কমে আসবে। মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া জেলার মানুষকে দৌলতদিয়া হয়েই ঢাকায় যেতে হবে।”
গ্রিন লাইন পরিবহনের যশোরের ব্যবস্থাপক সুব্রত ঘোষ বলেন, “আমাদের পাঁচটি এসি পরিবহন বেনাপোল থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। বেনাপোল থেকে দেড় হাজার টাকা এবং যশোর থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা ভাড়া।
“আপাতত পরিবহনগুলো ফরিদপুর হয়ে যাবে। এতে মাগুরার কিছু যাত্রী পাওয়া যাবে।”
এদিকে ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সভাপতি এম রায়হান বলেন, দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন এসেছে।
“আমাদের এ অঞ্চল অর্থাৎ ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার মানুষের পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত দূরবর্তী হলেও রাজধানীতে যেতে ভোগান্তি কমবে। কেননা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সিংহভাগ রুটের পরিবহন পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে পরিবহনের চাপ কমেছে। ফলে ঘাটে যান অথবা ফেরি জট আর থাকবে না।“