দৈনিক সমাজের কন্ঠ

মোঘল সম্রাট শাহজাহান এর ‘লাল কেল্লা’র আদ্যোপান্ত

ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ মোঘল সম্রাট শাহজাহান দীর্ঘদিন যাবত চিন্তা করছিলেন তার সাম্রাজ্যের রাজধানীটি আগ্রা থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। তিনি রাজসভায় সভাসদদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন যে রাজধানীটি আগ্রা থেকে সরিয়ে নিয়ে দিল্লীতে প্রতিষ্ঠা করবেন। তার জন্য দরকার সম্রাটের বাসস্থান নির্মাণ। কারণ এখান থেকেই তো তাকে ভারত উপমহাদেশের এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতে হবে। সুতরাং ডাক পড়লো মোঘল সাম্রাজ্যের ততকালীন দুই প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য স্থাপত্যশিল্পী ওস্তাদ আহমেদ ও ওস্তাদ হামিদের। তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হলো সম্রাটের বাসস্থান এমনভাবে নির্মাণের যার দুটি প্রবেশ পথ থাকবে এবং এই প্রবেশ পথ ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি প্রধান শহরের দিকে মুখ করে থাকবে। অর্থাৎ প্রবেশ পথের একটি হবে লাহোরের দিকে এবং অন্যটি দিল্লীর দিকে মুখ করে।

সম্রাটের নির্দেশনা মতো কাজে নেমে পড়লেন এই দুই স্থাপত্যশিল্পী। ১৬৪৮ সাথে এই কেল্লা নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এর জন্য সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর। পুরনো দিল্লীর যমুনা নদীর তীরে সম্রাটের জন্য নির্মিত হয় এক নতুন রাজকীয় ভবন। সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট শাহজাহানের নতুন রাজধানী।

নব নির্মিত লাল কেল্লাটি পুরোপুরি লাল রঙের কখনোই ছিল না। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের এক গবেষণা হতে জানা যায় যে, কেল্লার দালানের বিভিন্ন অংশে ব্যবহার করা হয়েছিল চুনাপাথর। তাই এর প্রকৃত রঙ ছিল শ্বেতবর্ণ। কিন্তু আবহাওয়া, জলবাযু ও দূষণের প্রভাবে একসময় এর এই শুভ্রতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এর উজ্জ্বলতা মলিন হতে থাকায় ইংরেজরা দুর্গের দেয়ালে লাল রং করে দেয়। উঁচু লাল দেয়ালে ঘিরে থাকা কেল্লাটিকে তার রঙই দিনে দিনে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। আর ইংরেজরা দুর্গটিকে ‘রেড ফোর্ট’ নামে ডাকতে শুরু করে।

স্থাপত্যশিল্পীরা শুধু কেল্লা নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি। এর সুরক্ষার কথাও চিন্তা করেছিলেন। সেজন্য কেল্লার চতুর্দিকে নির্মাণ করা হয় বিশাল পরিখা। এর পানি আসতো যমুনা নদী থেকে। কেল্লার সুরক্ষায় পরিখায় রাখা হতো কুমির। তারপরও যদি কেউ সেই পরিখা অতিক্রম করতো তারপরও তার পক্ষে সম্ভব হতো না কেল্লার ভিতরে প্রবেশ করা। কারণ কেল্লার দেওয়াল এমন পিচ্ছিল রাখা হতো যাতে কেউ দেওয়াল বেয়ে উঠতে না পার। আর এই পিচ্ছিল বিশাল উঁচু খাড়া দেওয়াল বেয়ে প্রবেশ করা এক কথায় অসম্ভব ছিল। তারপরেও কেল্লার সুরক্ষায় সারা দিন-রাত পালাক্রমে প্রহরী নিয়োজিত রাখা হতো।

লাল কেল্লার নির্মাণশৈলী সত্যিই অবাক করার মতো। এছাড়াও এর অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। লাল কেল্লার ভাস্কর্য ও শৈল্পিক উপস্থাপনা এককথায় অনবদ্য। কেল্লার অভ্যন্তরীণ অলংকরণ ও শিল্পকর্ম ছিল বিশ্বমানের। পাশ্চাত্য ও ভারতীয় শিল্পকলার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে তৈরি এই স্থাপত্য। এই দুই সংস্কৃতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট এই অপরূপ শৈল্পিক ব্যঞ্জনা এবং বর্ণময় রঙের ব্যবহার নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। এই কেল্লার স্বাতন্ত্র প্রশ্নাতীত। ভারতীয় ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন দিল্লীর এই লাল কেল্লা। আর তাই ১৯১৩ সালে লাল কেল্লাকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

 

সূত্রঃ রোয়ার