এক গোলে পিছিয়ে পড়ে এসব ভাবতে ভাবতে যখন প্রমাদ গুনছেন শিল্টন, আবার আসে ম্যারাডোনার ঝড়! পিটার বিয়ার্ডস্লে আর পিটার রিডের কড়া মার্কিং থেকে অনেকটা মোচড় দিয়ে বের হয়ে আসেন ম্যারাডোনা! পায়ের বলটা আলতো করে ঠেলে দিলেন সামনে থাকা ফাঁকা স্থানে! সাইডলাইনের পাশ দিয়ে ম্যারাডোনা বল নিয়ে ছুটছেন সাঁই সাঁই করে। ফেনুইক, বুচার এগিয়ে গেলেন তাকে থামাতে। কিন্তু ১০ নম্বর জার্সি পরিহিত সে খর্বকায় মানুষটি যেন বল নিয়ে উড়ছেন। ব্যর্থ হয়ে দুই ডিফেন্ডার যখন তার পেছনে ছুটতে শুরু করলেন; শিল্টনও এগিয়ে এলেন জটলা তৈরি করে যাতে বল ঠেকানো যায়। কিন্তু ম্যারাডোনা যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে ৪০ গজের এই মাঠে নেমেছেন। সাতজনকে কাটিয়ে প্রবল গতিতে ছুটে এসেছিলেন। সেই গতি বজায় রেখেই শিল্টনকে পাশ কাটিয়ে গেলেন। এরপর বাম পায়ের মাপা শট খুঁজে নিলো ইংলিশদের গোলবার।
তবে আজ একজন রক্ত-মাংসের মানুষের দেবতায় পরিণত হবার গল্প নয়। আমরা ফিরে যাব সুদূর ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনাতে। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে অনুশীলন শেষে থেকে বাসায় ফিরছেন ১৭ বছর বয়সী ম্যারাডোনা। আজ ‘৭৮ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দল ঘোষণা করবেন আর্জেন্টিনার কোচ, কথাটা মনে পড়লেই তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর; কিন্তু তাতে কী? গত দুই বছর ধরে ক্লাবের হয়ে তিনি পায়ের যে জাদু দেখিয়েছেন, তাতে জাতীয় দল থেকে তাকে উপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই। বাসায় ফিরে রেডিও চালু করে বসলেন তিনি। তার পরিবারও যখন তাকে ঘিরে বসলে, উত্তেজনাও তাকে আরও পেয়ে বসলো।
বুয়েনস আইরেসের বস্তিতে খুব ছোট্ট একটি ঘরে থাকত তার পরিবার। নর্দমার পাঁকের গন্ধে সে বস্তিতে টেকা মুশকিল। বাড়ির ছাদের অবস্থা ছিল প্রচণ্ড ভঙ্গুর। প্রতিদিন মনে হতো, এই বুঝি ভেঙে পড়বে। কিন্তু ডিয়েগোর পরিবার সেখানেই মাথা গুঁজে থাকত। দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে এসব পরিবারের ছেলেদের একমাত্র সুযোগ ছিল ফুটবল। ম্যারাডোনাও ফুটবলকে বেছে নিলেন। ছোট থাকতে তার এক খালাতো ভাই তাকে একটি চামড়ার বল উপহার দিয়েছিল। প্রতি রাতে তিনি সে বলটা বুকে জড়িয়ে ঘুমাতেন। কিন্তু তার মা সবসময়ই ভাবতেন, ম্যারাডোনা সামান্য কোনও কিশোর নন, বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়ার মত প্রতিভা আছে তার ভেতর। সেই ভরসাতেই ম্যারাডোনা পৌঁছে গেছেন দেশের হয়ে ফুটবল খেলার দ্বারপ্রান্তে। তাই আজ তার এবং ম্যারাডোনার পরিবার উভয়ের জন্য অন্যতম বিশেষ দিন।
রাজধানী শহরের ১৭ বছর বয়সী ম্যারাডোনা যখন এক স্বপ্নপূরণের অপেক্ষায় রেডিও কানে নিয়ে বসে আছে, অন্যদিকে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের হেডকোয়ার্টারে হাতে সিগারেট নিয়ে চিন্তিত মুখে পায়চারি করে চলেছেন সিজার লুইস মেনোত্তি। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ তিনি, একটু পরই বিশ্বকাপ সামনে রেখে দল ঘোষণা করবেন। এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই বড্ড চিন্তিত তিনি। ঘরের মাঠে এবার বিশ্বকাপ। চাপটা তাই অন্য সময় থেকে অনেক বেশি। এমন চাপ সামনে রেখে তিনি এক অসম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। গত দুই বছর ধরে দারুণ খেলে আসা ম্যারাডোনাকে তিনি দলে রাখবেন না। কারণ, তার মনে হয়েছে এই বিশ্বকাপের চাপ ১৭ বছর বয়সী ম্যারাডোনা নিতে পারবেন না। এছাড়াও তার হাতে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কম না। তিনি চান তাদের নিয়েই এই বিশ্বকাপে যেতে।
মেনোত্তি বেশ শক্ত মানুষ, নিজে যা বোঝেন তাই করেন, মানুষের কথায় কোনো কান দেন না। সংবাদ সম্মেলনে বিরস মুখে তিনি দল ঘোষণা করলেন। সেখানে ‘বিস্ময়বালক’ ম্যারাডোনার নাম নেই। চারিদিকে গুঞ্জনের জোয়ার উঠলো। মেনোত্তি সেসব কানে তুললেন না, কয়েকটি প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে সেদিনের সংবাদ সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করলেন।
মেনোত্তির এমন সিদ্ধান্ত পর কখনও তিনি সেভাবে সমালোচিত হননি। ম্যারাডোনা না থাকুক, সেবার মেনোত্তি নিয়ে গেলেন উবালদো ফিলোল, অস্কার ওরতিজ, আলবার্তো তারান্তিনি, মিগুয়েল ওভিয়েদো, ড্যানিয়েল বেরতোনি, মারিও কেম্পেস ও ড্যানিয়েল প্যাসারেল্লাদের। মেনোত্তির শিষ্যরা ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ হাতছাড়া করেনি। কেম্পেসের জাদুতে হল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা।
ম্যারাডোনা ঘরে বসে দেখলেন আর্জেন্টিনার জয়যাত্রা। তার মনে সেদিন কী চলছিল, তা আমরা জানি না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আটাত্তরের বিশ্বকাপ হাতছাড়া হবার পর তিনি পাখির চোখ করে রেখেছিলেন পরের বিশ্বকাপকে। পরের বছর অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে বাম পায়ের জাদু দেখালেন ম্যারাডোনা। ডাগআউটে সিগারেট হাতে স্বয়ং মেনোত্তি তার খেলা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। ‘৮২ এর বিশ্বকাপ আসতে আসতে ম্যারাডোনা তখন একদম পরিণত একজন খেলোয়াড়। ততদিনে তিনি খেলেন বোকা জুনিয়র্সে। তাছাড়া বিশ্বকাপের বছরই ৫ মিলিয়ন ইউরো রেকর্ড ফি’তে তিনি পাড়ি জমান বার্সেলোনায়। আটাত্তরের বিশ্বকাপ জেতা দলের অনেকেই সে দলে জায়গা পেলেন। গোলরক্ষক হিসেবে থাকলেন পুরনো ভরসা ফিলোল। এছাড়াও কেম্পেস, প্যাসারেল্লা, বার্তোনি, তারান্তিনোর পাশাপাশি সে দলে সুযোগ পেলেন ২৬ বছর বয়সী ভালদানো ও ২১ বছর বয়সী ম্যারাডোনা।
সে বছর বিশ্বকাপ আয়োজন করে স্পেন। স্পেনের ক্লাব বার্সেলোনার সাথে ম্যারাডোনার চুক্তি হয়ে গেছে বিশ্বকাপের আগেই। তাই কাতালান সমর্থকরা আগেভাগেই তাদের নতুন খেলোয়াড় সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়ে গেলেন। এমন পরিস্থিতি দেখে স্পেনের মাঠে নিজেকে প্রমাণ করতে প্রথম থেকেই মরিয়া ছিলেন তিনি।
প্রথম ম্যাচ বেলজিয়ামের বিপক্ষে। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ক্যাম্প ন্যুতে। নতুন ঘরের মাঠকে নিজের পরিচয় জানানোর দুর্দান্ত সুযোগ ম্যারাডোনার সামনে। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে হেরে বসলো। পুরো ম্যাচে ম্যারাডোনা থাকলেন নিজের ছায়া হয়ে। আসলে সে স্পেন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলে বয়স্ক খেলোয়াড়ের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি ছিল। যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশই ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে এসেছেন। তাই মাঠে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করা তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। তরুণ যারা ছিলেন, তারা একদমই অপরিপক্ব। তাই প্রথম ম্যাচ থেকেই বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলার জন্য অভিজ্ঞতা ও তরুণ খেলোয়াড়ের সঠিক সংমিশ্রণে অভাবে ভুগতে লাগল আলবিসেলেন্তেরা।
প্রথম ম্যাচে ম্যারাডোনাসহ পুরো দলের এমন দুর্বল পারফরম্যান্সের পর ম্যারাডোনার দিকে সমালোচনার তীর ছুড়লেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি জিকো। তবে তার সমালোচনার জবাব ম্যারাডোনাও দিলেন পরের ম্যাচে, হাঙ্গেরির বিপক্ষে ৪-১ গোলের জয়ের ম্যাচে নিজে করলেন দুই গোল।
এর পরের ম্যাচ এল সালভাদরের বিপক্ষে। এ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বেলজিয়াম জয়ের পাশাপাশি “ম্যারাডোনাকে আটকাও, আটকে যাবে আর্জেন্টিনা” নীতি চালু করে দিয়েছিল। এল সালভাদরও সেই নীতিই অনুসরণ করল। এ দলটি স্পেন বিশ্বকাপ শুরু করেছিল হাঙ্গেরিকে ১০ গোলে হারিয়ে। কিন্তু এমন জয়ের পর অদ্ভুতভাবে তারা অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলা শুরু করে। আর্জেন্টিনার সাথে যথারীতি তারা একই ট্যাকটিক্সে খেলা শুরু করে। পুরো ম্যাচে ম্যারাডোনা ছিলেন বাক্সবন্দী। তবে পেনাল্টিতে প্যাসারেল্লার এক গোলের পর ৫২ মিনিটে বার্তোনির গোলে জিতে পরের রাউন্ডে ওঠে আর্জেন্টিনা। পুরো ম্যাচে আর্জেন্টিনার নাম্বার টেন নিজের ছায়া হয়ে ঘুরেছেন। ম্যাচে একটামাত্র দারুণ ফ্রি-কিকে গোল করার দ্বারপ্রান্তে যাওয়া ছাড়া এ ম্যাচে তিনি আর কিছু দিতে পারেননি আর্জেন্টিনাকে। তাই তার দল পরের রাউন্ডে উঠলেও ম্যারাডোনাকেও দলের জন্য অবশ্যই কিছু করতে হতো।
সেকেন্ড স্টেজ বা কোয়ার্টার ফাইনালে গ্রুপ সি’তে আর্জেন্টিনা। মেনোত্তির দল খেলবে ইতালি ও ব্রাজিলের বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচ আজ্জুরিদের বিপক্ষে। কাগজে-কলমে যারা আর্জেন্টিনা থেকে একদম বিপরীতমুখী ফুটবল খেলে। ইতালির কোচ এনজো বিয়ারজোতও বেলজিয়ামের দেখানো পথে হাঁটলেন। জুভেন্টাসের ডিফেন্ডার ক্লদিও জেন্টাইলকে দায়িত্ব দিলেন ম্যারাডোনাকে কড়া মার্ক করে আটকে রাখার জন্য। পুরো ম্যাচে ম্যারাডোনার সাথে আঁঠার মতো সেঁটে রইলেন জেন্টাইল। সতীর্থদের কাছ থেকে তেমন বল এলো না। যা-ও বা কিছু পেলেন, মারকুটে ধরনের ডিফেন্ডার জেন্টাইল সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। সে ম্যাচে আর্জেন্টিনা হারলো ২-১ গোলে। আর্জেন্টিনার হয়ে একমাত্র গোল করেছিলেন তৎকালীন রিভার প্লেটের স্ট্রাইকার র্যামন ডিয়াজ।
এ ম্যাচের অনেক বছর পরে ক্লদিও জেন্টাইল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
”আমি টানা দুইদিন ধরে ম্যারাডোনাকে লক্ষ্য করছিলাম। তার খেলার ভিডিও দেখে বের করার চেষ্টা করছিলাম, কী কৌশল অবলম্বন করলে তাকে আটকানো যাবে। ম্যাচে আমি তাকে সুকৌশলে মার্ক করে রেখেছিলাম, যাতে সতীর্থদের কাছ থেকে সে যেন পাস না পায়। কারণ, সুবিধামতো জায়গায় একটি পাস পেলেই সে আমাদের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
সে ম্যাচে জেন্টাইল ম্যারাডোনার পা থেকে বল কেড়ে নিতে একের পর এক ফাউল করেই চলেছিলেন। কিন্তু রেফারি ফাউলগুলো একের পর এক উপেক্ষা করে যাচ্ছেন। ৩৫ মিনিটে খুব খারাপ ধরনের ফাউলের পর তেড়েফুঁড়ে আবেদন জানাতেই মেক্সিকান রেফারি মারিও রুবেন ভাস্কেজ তাকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে দেন।
প্রথম ম্যাচ হেরে মেনোত্তির দলের সামনে পাহাড়সমান চিন্তা। দ্বিতীয় ম্যাচে ব্রাজিলের কাছে যেকোনো মূল্যে জিততে হবে। কিন্তু ম্যাচ শুরু হওয়ার ১১ মিনিটের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল, এই ম্যাচে ভাগ্যদেবী আর্জেন্টিনার পক্ষে নেই। ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ব্রাজিল রীতিমতো ছেলেখেলা শুরু করলো। জিকোর সাথে ম্যারাডোনার তখন দারুণ দ্বৈরথ। সেই জিকোই ১১ মিনিটে প্রথম গোল করলেন। ৬৬ মিনিটে সার্জিনহো ও ৭৮ মিনিটে সেলেকাও ডিফেন্ডার জুনিয়র আর্জেন্টিনার কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন।
পুরো ম্যাচে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালালেন ম্যারাডোনা। শেষ সময়ে প্রচণ্ড হতাশা ও ক্লান্তি তাকে জাপটে ধরল। ৮৫ মিনিটে বল দখলের সময় ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার জোয়াও বাতিস্তা সামনে এলে বিরক্ত হয়ে বল রেখে তার বুক বরাবর লাথি মেরে বসেন তিনি। ফলস্বরূপ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় ম্যারাডোনাকে। বিরক্তি ও হতাশায় মুখ মুছতে মুছতে সাইডলাইনের প্রান্তে যেতেই তার দিকে এগিয়ে আসেন আর্জেন্টাইন ঝাঁকড়া চুলের ডিফেন্ডার তারান্তিনো। নতমুখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ম্যারাডোনাকে বুকে টেনে কপালে চুমু এঁকে দেন।
কিন্তু ম্যারাডোনার ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই। হতাশ ও বিরক্ত মুখেই মাঠ ছাড়লেন তিনি। সেদিন স্পেনের সারিয়া স্টেডিয়ামে বসা কেউ কি ভেবেছিল এই নতমুখে বিদায় নেওয়া ম্যারাডোনাই চার বছর পর মেক্সিকোর আকাশে এক সোনালী ট্রফি তুলে ধরবেন?
Source Roar bangla.