নড়াইলে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মুক্ত দিবস পালিত

0
0

নড়াইল  প্রতিনিধি:বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নড়াইল মুক্ত দিবস পালিত হয়েছে। মঙ্গলবার ( ১০ ডিসেম্বর) এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল শহরের রূপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে গণকবর, পুরাতন বাস টার্মিনাল এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, স্মৃতিস্তম্ভ এবং আদালতের পশ্চিম পার্শ্বে চিত্রা নদীর তীরে অবস্থিত বধ্য ভূমিতে পুস্পমাল্য অর্পণ, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকী যুদ্ধ, জারি গান এবং স্মৃতিচারণ। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায় জানান, আজ সকাল ৯টায় গণকবর, বধ্যভূমি, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পমাল্য অর্পণ করে জেলা প্রশাসন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, পুলিশ প্রশাসন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান কমান্ড, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জেলা শিল্পকলা একাডেমী এবং চিত্রা থিয়েটার পুস্পমাল্য অর্পণ করে। বেলা ১১টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নড়াইল ইউনিট কমান্ডের আয়োজনে এক স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আজ ১০ ডিসেম্বর, নড়াইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে নড়াইলকে মুক্ত করেন। সেদিন উল্লাসিত জনতা ঘর ছেড়ে রাজপথে বেরিয়ে পড়েন। আনন্দ উল্লাসে উড়িয়ে দেন লাল-সবুজের পতাকা। বীরমুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের সদর দপ্তর করা হয়। তিনি জানান, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এমপিএ শহীদ আলী খান, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান, লোহাগড়া হাই স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। ৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে শহরের ওপর ব্যাপক গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে। এতে শহর জনশুন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের নিকট গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন দোহার উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িযারায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলার কারণে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হতে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় গানবোটযোগে ইতনা গ্রামে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে। ওই সময় নড়াইলের জামায়াত নেতা মওলানা সোলায়মানের নেতৃত্বে “শান্তি বাহিনী গঠিত হয়”। এ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে দেশপ্রেমিক শত শত মানুষকে ধরে এনে নড়াইল ডাক বাংলোয় আটক রাখা হত। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে মাওলানা সোলায়মান রেজিস্ট্রারে যাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে “রিলিজ ফর ইভার” লিখে দিত তাদের ইসকর্ট পার্টি ও জল্লাদরা গভীর রাতে নড়াইল শহরের লঞ্চঘাটের প¬াটুনের ওপর নিয়ে জবাই করে নদীতে ফেলে দিত। এভাবে মাওলানা সোলাইমান চেনা অচেনা প্রায় ৩ সহস্রাধিক মানুষকে জবাই করে হত্যা করে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। এছাড়া ব্যাক্তিগত আক্রোশে মাওলানা সোলায়মান নিজগ্রাম তুলারামপুরের আওয়ামী লীগের সদস্য নড়াইল ভিসি স্কুলের মাষ্টার আতিয়ার রহমান তরফদার, আব্দুস সালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার, মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা, মকবুল হোসেন সিকদার, চাচড়া গ্রামের ফয়জুর রহমানসহ অনেককে ধরে এনে শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় নিয়ে নিজেদের দিয়ে কবর খুড়ে তাদের হত্যা করে গর্তের মধ্যে পুতে রাখে। এছাড়া নকশালরা পেড়লী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ মোল্যা, আবুয়াল হোসেন, নায়েব নজির হোসেনসহ অনেককে হত্যা করে। এভাবে শত কষ্টের মাঝেও দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দুর্জয় আকাঙ্খা নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে সদর থানায় উজির আলী, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী ও কালিয়া থানায় ওমর আলীকে এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান ও কালিয়া থানায় আব্দু মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করে নড়াইলে প্রবেশ করে। অক্টোবার মাস হতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশীদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাটিকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডাররা আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পণ না করায় ৭ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাষ্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপি একত্রিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে। প্রচার যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহ’র নেতৃত্বে নড়াইর কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর বিজয়ের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, শেখ আজিবর রহান,রকিবুল ইসলাম,আব্দুল হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমন চালায়। পাল্টা আক্রমণে মো. নজির হোসন মোল্যার নেতৃত্বাধীন বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। ওই দিনই শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা তা অস্বীকৃতি জানায়। এসময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চতুর্দিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে একজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। শীতের রাতে প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকে। জয় বাংলা শ্লোগানে শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলে ৫ জন খেতাবপ্রাপ্ত হন; তারা হলেন— বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান। ১৪ ডিসেম্বর এ সেক্টরের মেজর মঞ্জুর নড়াইলে আসেন এবং মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলণ করা হয়। এছাড়া সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদিকে চিত্রা থিয়েটারের উদ্যোগে বিকালে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ১৯৭১ সালে নড়াইল মুক্ত দিবসের সেই যুদ্ধের দৃশ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে অভিনয় করে দেখানো হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here