দৈনিক সমাজের কন্ঠ

বিলুপ্তির পথে গরিবের বাংলা ‘এসি’ ঘর (মাটির ঘর)

ড, শেখ শাহরিয়ার আহমেদ (সম্পাদক) – বিলুপ্তির পথে গরিবের বাংলা ‘এসি’ ঘর নামক মাটির ঘর। মাটির দেয়াল, ওপরে টিন বা খড়ের চাল, সামনে বড় উঠান, এই হলো ‘গরিবের এসি’ ঘর। মাটির দেয়ালে গড়া সাতচালা বা আটচালা জোড়া বাংলা ঘর এখন আর দেখা যায় না। দেখা মেলে না গোলপাতায় বা খড়ে ছাওয়া মাটির ঘরও। সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়ির সামনে সেই বৈঠকখানাতো বিলুপ্তই হয়ে গেছে। শান্তির নীড় সেসব মাটির ঘরের স্থান দখল করেছে ইট-পাথরের দালান। চিরচেনা গ্রামগুলোকেও তাই এখন অচেনা লাগে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঢুকলে দু’একটি মাটির ঘর চোখে পড়ে। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও কনকনে শীতে আদর্শ বসবাস-উপযোগী এসব ঘর তৈরি হতো মাটিতেই। এটেল মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর কাঠ বা বাঁশের চাল তৈরি করে খড়-কুটা, গোলপাতা, টালি অথবা ঢেউটিন দিয়ে ছাওয়া হতো। মাটি কুপিয়ে ও পানি দিয়ে কাদায় পরিণত করার পদ্ধতিকে জাব বলা হয়। জাব কেটে তা সুচারুভাবে গেঁথে ভাজে ভাজে তৈরি করতে হয় দেয়াল। যিনি মাটির চাপ গেঁথে দেয়াল ও বাঁশ দিয়ে চাল তৈরি করেন তাকে ঘরামি বলা হয়। ঘরের বারান্দা ও চালের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ঘরকে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। চারপাশে বারান্দা থাকা ঘরকে আটচালা এবং তিনপাশে বারান্দা থাকা ঘরকে সাতচালা ঘর বলা হয়। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা একে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। শৈল্পিক আল্পনায় ফুটে উঠতো নিপুণ কারুকার্য। বৈঠকখানা বা দহলুজঘরে এক সময় বসতো গ্রামের মানুষের আড্ডা, বিনোদন আর গল্পের আসর। সাধারণ মানুষ তাদের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করতেন মোড়ল বা মাতবরের এ দহলুজঘরে বসে। হুক্কায় টান দিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতেন।
ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির ঘর শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। অথচ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে ইট-সিমেন্টের ঘর নির্মাণে উৎসাহী হচ্ছে মানুষ। আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের আবর্তে তাই দালান-কোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির ঘর।
আশির দশকেও বাংলাদেশের সকল গ্রামে কাঁচা ঘরবাড়ি দেখা যেতো। গরিবের এসির সংখ্যাধিক্যে ইট-পাথরের তৈরি পাকা দালানের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। সেই দিন বদলে গেছে। কাঁচাঘর ফেলে পাঁকাঘর নির্মাণে ঝুঁকছেন গ্রাম বাংলার মানুষ। ফলে, বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাতেগোনা দু’একটি মাটির ঘর দেখা যায়। অধিকাংশ বাড়ি এখন ইট পাথরের তৈরির ফলে
আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এসব মাটির ঘর।