ডা. শাহরিয়ার আহমেদ – ভারতবর্ষে ৭০০ বছর আগে ”ডাকঘর“ চালু করেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। প্রযুক্তি আর উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা এবং নৈতিক আচার-আচরণের তুলনামূলক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একটা সময়ে মানবসভ্যতা ‘যন্ত্রনির্ভরতা’-র স্বচ্ছন্দ গণ্ডি ভেদে ছিল অনেকাংশেই ‘মনুষ্যনির্ভর’… আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার এই ধীরে ধীরে উন্নতির মূলেও রয়েছে মানুষের স্বয়ংক্রিয় ভাবনা, একইসঙ্গে সুদূরপ্রসারী ধারণার নির্যাস। একটা সময়ে মানুষে মানুষে যোগাযোগ এবং কুশল বিনিময়ের মাধ্যম ছিল হাতে লেখা চিঠি, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক ঘটনাবিবরণীও এই চিঠিপত্রের মধ্যেই দিয়েই আদান-প্রদান করা হত। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে চিঠিপত্রের ব্যবহার সেইভাবে চোখে পড়ে না। আমাদের হাতে লেখা চিঠির জায়গা নিয়েছে বৈদুতিন মাধ্যম চালিত ই-মেল এবং আরও অনেক বিষয়। ঈষৎ হলদেটে খামে পত্রালাপের মাধ্যমে সংবাদ বিনিময়ের মাধ্যম আজ অন্তর্হিত এমনটা বললেও খুব ভুল হবে না। কার্যত বলা যায় সময়কে পিছনে ফেলে মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক অনিয়ন্ত্রিত লড়াই।
ভারতবর্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক বিকাশ ঘটে মধ্যযুগীয় ইসলাম শাসকদের হাতে। ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রি পর্যন্ত দিল্লির প্রথম সুলতানি শাসক কুতুবুদ্দিন আইবকের সময় ডাক বা যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা ক্রম উন্নতির চেহারা আমাদের চোখে পড়ে। কতগুলি নতুন শব্দও তিনি চালু করেছিলেন, যেমন কাসিদ (দূত), ধাওয়া (রানার) এবং উলাগ (ঘোড়ার সাহায্যে বহনকারী)। এই ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী, যিনি জানামতে সর্বপ্রথম ডাকচৌকি স্থাপন করেছিলেন। তিনি ১২৯৬ সালে ঘোড়ায় চড়া এবং পায়ে হাঁটা ডাকবাহকের সাহায্যে তথ্য পরিবহণের ব্যবস্থা চালু করেন। তার সময়ে ডাক বিভাগকে বলা হতো ‘মাহকামা–ই–বারিদ’। কুতুবুদ্দিন আইবকের যোগাযোগ ব্যবস্থার এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছিল পরবর্তী শাসকেরাও… মহম্মদ বিন তুঘলকের সময়কালেও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি চোখে পড়ে। ইবন বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় সেই সময়ে দুইধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক, রানার বা বার্তাবাহকের মাধ্যমে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান। দুই, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ডাকব্যবস্থার প্রচলন। এই ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকেই জানা যায় কীভাবে কম সময়ের মধ্যে এক প্রদেশ থেকে অন্য আর এক প্রদেশে খবর চলাচলের সুচারু পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল সেই সময়ে।
প্রাচীন এবং মধ্যযুগের সূচনা পর্বের ইতিহাস বাদ দিলে অনেকেই একথা সর্বাগ্রে স্বীকার করবে যে শেরশাহের শাসনকালেই ডাকব্যবস্থার সার্বিক বিকাশ ঘটে। প্রথমেই তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাস্তাঘাট এবং সড়কপথের উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁ থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ মাইল দীর্ঘ পথ নির্মাণ করেছিলেন, যা ‘সড়ক-ই-আজম’ বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামেও বিশেষ পরিচিত। ঘোড়ার পিঠে চড়ে ডাক ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটে তাঁর শাসনামলে। নির্মিত এই রোডটি উপমহাদেশের সিন্ধু উপত্যকার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং এর প্রতিটি প্রবেশদ্বারে দুটি করে ঘোড়া রাখা হত, কয়েকশো প্রবেশ দ্বার ছিল… এইভাবেই তিনি যোগাযোগকে সক্রিয় রাখতে বিশেষ ভূমিকা স্মরণযোগ্য। শেরশাহ প্রায় ১,৭০০টি ডাকঘর নির্মাণ করেন এবং ঘোড়াসহ প্রায় ৩,৪০০ জন বার্তাবাহক নিযুক্ত করেন। এই সময় মীর মুন্সি অর্থাৎ রাজকীয় ফরমান, যোগাযোগ ও ডাক বিভাগের সচিব দারোগা–ই–চৌকি পদধিকারী কর্মকর্তার তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। সম্প্রসারিত ডাক ব্যবস্থাকে বলা হতো দিওয়ান–ই–ইনসা। তারিখ নবীস পদধিকারী দুজন করণিকের অধীনে নিম্নবর্ণের গোত্র থেকে নিয়োজিত মৈওয়ার নামক কমচারীরা শাহী তথ্য আদান-প্রদান করত। বাংলা শাসনকালে মুগলরা দারোগা–ই–ডাকচৌকি ব্যবস্থা বহাল রাখেন। ডাক চৌকিগুলি মূলত প্রাদেশিক সরকার নিয়ন্ত্রণ করত।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে ১৬১০ সাল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দিল্লির ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডাক গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য ডাকচৌকির দারোগা বা সুপারিনন্টেন্ডেন্ট নিয়োগ করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রগুলির কয়েকটি বিভাজন হয় তাঁর আমলে যেমন- ফরমান (বাদশাহের আদেশ); শুক্কুক (সরাসরি কোন ব্যক্তির প্রতি বাদশাহের পত্র); নিশান (বাদশাহ ছাড়া রাজ পরিবারের কোন ব্যক্তির পত্র); হসবুল হুকুম (সম্রাটের নির্দেশক্রমে লেখা মন্ত্রীর পত্র); সনদ অর্থাৎ নিয়োগপত্র; পরওয়ানা (নিম্নপদস্থ কর্মচারীর প্রতি প্রশাসনিক নির্দেশ) এবং চ. দস্তক (প্রশাসনিক অনুমতিপত্র)। বলা যেতে পারে এই সময় থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে এই পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিকতার সংযোগে বর্তমান ডাকযোগ বা পোস্ট অফিস-এর ধারণাটি আমাদের সামনে আসে।