আসামিরা দ্রুত শনাক্ত হয়ে যাওয়ায় বিচার নিয়ে আশাবাদ যেমন আছে, তেমনি অতীতের নানা ঘটনায় সংশয়ও আছে। কারণ আলোচিত বেশ কিছু হত্যার তদন্ত আছে থমকে, কারা খুন করেছে সেটা জানা যায়নি কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারো কারো নাম এলেও আগায়নি বিচার।
এবার দেখে নেওয়া যাক তুমুল আলোচিত বেশ কিছু হত্যার বিচার কতদূর আগাল।
তিমিরে তনু হত্যার তদন্ত
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলা তিন বছর ধরে সিআইডির ল্যাবে ‘বন্দি’। পুলিশ বলছে, ‘কাজ চলছে’। আর পরিবারের অভিযোগ, ‘তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই পুলিশের।’
২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি বাসায় পড়াতে গিয়েছিলেন তনু। পরে তার মরদেহ পাওয়া যায় পাশের একটি জঙ্গলে। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে পরিবারের অভিযোগ। খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ হয় সারা দেশেই।
সে সময় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। থানার পুলিশ ও ডিবির পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি কুমিল্লা। তনুর দুই দফা ময়নাতদন্তে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ মৃত্যুর স্পষ্ট কারণ জানায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন এই সময়কে বলেন, ‘আমরা দেড় বছর হলো ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের নমুনা ল্যাবে পাঠিয়েছি। কিন্তু ওই প্রতিবেদন আমরা এখনো হাতে পাইনি। এটা বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলে আমরা মামলার তদন্তের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারব। তবে আমরা প্রকাশ্যে ও গোপনে তদন্ত কাজ অব্যাহত রেখেছি।’
রহস্য হয়েই রইল মিতু হত্যা
চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা নিয়ে তোলপাড় হলেও তদন্তে নেই এতটুকু অগ্রগতি। আড়াই বছর ধরেই এক বিরাট রহস্য হয়ে রয়েছে মামলাটি। ইচ্ছা করেই সব আটকে রাখা হয়েছে কি না এ নিয়ে কানাঘুষাও কম নয়। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে তা বলতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় মিতুকে। এ ঘটনায় নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন স্বামী বাবুল আক্তার। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি সে সময় ব্যাপক সহানুভূতি তৈরি হয়। পরে নিজ বাহিনীর চাপে তিনি চাকরি ছাড়েন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে। যদিও পুলিশ তা স্বীকার করে না। আর এ নিয়েই তৈরি হয়েছে রহস্য।
বাবুলের চাকরি ছাড়া আর হত্যার কারণ, কারা জড়িত, সে বিষয়টি বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ন্যস্ত করা হয়।
শুরুতে পাশে থাকলেও এখন বাবুলের দিকে আঙুল তুলছে মিতুর পরিবার, যিনি এখন একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুজ্জামান বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।’
তিন্নি হত্যা মামলা আটকে ১৬ বছর
১৬ বছরেও শেষ হয়নি মডেল তিন্নি হত্যা মামলার বিচার। ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় সৈয়দা তানিয়া মাহবুব হক তিন্নির লাশ। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
কিন্তু অভি উচ্চ আদালতে একটি রিট করলে থেমে যায় মামলার বিচার। পরে ওই রিটের নিষ্পত্তি হলেও মামলা রায়ের পর্যায়ে আসেনি। বর্তমানে ঢাকা জেলার সপ্তম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। যদিও অভি এখন দেশে নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আবদুল মান্নান কিছু জানাতে পারেননি। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘অনেকদিন হয়ে গেছে মামলার নথি না দেখে বলা যাবে না।’
চাঞ্চল্যকর রিশা হত্যার রায়ের অপেক্ষা
বহুল আলোচিত লিটল উইলস ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা হত্যার বিচার চলছে ঢাকার ছয় নম্বর নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। এই ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় তিন বছরেও রায় হয়নি। একমাত্র আসামি ওবায়দুল ইসলাম অবশ্য জেলহাজতে।
২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট রিশাকে তার বিদ্যালয়ের সামনে ফুট ওভারব্রিজের ওপর ছুরিকাঘাত করার অভিযোগ ওঠে দর্জি দোকানের কর্মচারী ওবায়দুল খানের বিরুদ্ধে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার সময় মৃত্যু হয় রিশার।
হামলার দিনই কিশোরীটির মা তানিয়া বেগম রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর ওবায়দুলকে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার পুলিশ পরিদর্শক আলী হোসেন। অভিযোগপত্রে ২৬ জনকে সাক্ষী করা হয়।
বাবা-মেয়ের ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’র বিচারে ধীরগতি
গাজীপুরের শ্রীপুরে বখাটেদের অত্যাচার সইতে না পেরে বাবা-মেয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দেওয়ার ঘটনাটি তুমুল আলোচনা তৈরি করেছিল বছর দুয়েক আগে। এরপর মামলা, আসামিরা শনাক্ত, তদন্ত, আদালতে প্রতিবেদন জমা, গ্রেপ্তারও, সবই হয়েছে। কিন্তু শুনানি রায়ের পর্যায়ে আসেনি এখনো। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ চলছে গাজীপুরের জেলা জজ আদালতে।
২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল শ্রীপুর থানার গোসিংগা ইউনিয়নের কর্ণপুর (সিটপাড়া) গ্রামের হযরত আলী তার মেয়ে আয়েশা আক্তারকে নিয়ে রেলস্টেশনের পাশে তিস্তা এক্সপ্রেসের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঘটনার পরদিন হযরত আলীর স্ত্রী হালিমা বেগম আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সাতজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন কমলাপুর রেলওয়ে থানায়।
মামলায় অভিযোগ ছিল, আট বছরের আয়েশাকে উত্ত্যক্ত করতেন স্থানীয় ফারুক হোসেন। অভিযোগ নিয়ে ফারুকের বাবা ফজলু মিয়ার কাছে গিয়েছিলেন হযরত আলী। প্রতিকার না পেয়ে তিনি যান গোসিংগা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবুল হোসেন ব্যাপারীর কাছে। তিনি হযরত আলীকে পাগল বলে তাড়িয়ে দেন।
অরিত্রীর ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’র মামলা
ভিকারুননিসা নূন স্কুলে সবে নবম শ্রেণিতে পড়তো মেয়েটি। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় নামি স্কুলে দিয়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু তার বাবার সঙ্গে শিক্ষকদের ‘অন্যায্য’ আচরণে অপমানিত হয়ে অরিত্রি অধিকারী আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর। তদন্তও শেষ হয়েছে। প্রতিবেদন জমা পড়েছে আদালতে। কিন্তু বিচার শুরু হয়নি এখনো।
অরিত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। চলতি বছরের ২৯ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম আদালতে তা জমা দেন। এই প্রতিবেদনের ওপর কোনো আপত্তি আছে কি না তা জানাতে বাদীকে ৩০ এপ্রিল সময় দিয়েছে আদালত।
পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রী মোবাইলে নকল করেছে এমন অভিযোগে তার বাবা-মাকে অপমান করে কক্ষ থেকে বের করে দেন। পরে অরিত্রি তার ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেয়। পরদিন পল্টন থানায় মামলা করেন অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী।
প্রতিকার হয়নি আফসানার মৃত্যুর
ঢাকার মিরপুরের সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির স্থাপত্য বিদ্যার শেষ বর্ষের ছাত্রী আফসানা ফেরদৌসের আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলাও আড়াই বছরেও শেষ হয়নি। মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আফসানার লাশ শনাক্ত করে তার পরিবার। তখন তার ভাই রাব্বি জানান, রবিন নামে এক ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল আফসানার। তারা নিজেরা বিয়েও করে। পরে আফসানা কাবিনের জন্য চাপ দিলে তার কাছে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন রবিন। চলতে থাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে রবিন বলেন, ‘হয় আমার দাবি পূরণ করো, নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে মরো।’
তেজগাঁও সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সে সময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনসহ পাঁচজনের নামে একটি মামলা করেন রাব্বি। তদন্ত শেষে মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
— ঢাকা টাইমস