দৈনিক সমাজের কন্ঠ

হায়দ্রাবাদ, গোয়া, সিকিম: ভারত ভুখন্ডে বে-দখল হয়ে যাওয়া ৩টি রাজ্য

সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – হায়দ্রাবাদ, গোয়া, সিকিম: ভারত ভুখন্ডে দখল হয়ে যাওয়া ৩টি রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে স্বাধীন হয় ভারত। কিন্তু স্বাধীন হবার সাথে সাথেই ভারতের বিশাল স্থলভূমি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রাচীনকাল থেকে নবাব, রাজা আর জমিদার শাসিত সমাজ ব্যবস্থা এবং দুর্গম অঞ্চলের কারণে স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথেই সমগ্র দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না একক সরকারের পক্ষে।

তবেও এ কথাও ঠিক যে, কিছু কিছু নেটিভ রাজা ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও রাজাই ছিলেন। এতকাল তাদের হাতে শাসিত অঞ্চলগুলো তাদের হাতেই ছিল। মূলত সরকারের অনুগত্য স্বীকার করে নেওয়াতে তাদের উপর কোনো চাপ ছিল না। কিন্তু কিছু অঞ্চল ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার পরে ভারতে যোগদান করতে অস্বীকার করল নিজেরাই স্বাধীন থাকার অভিপ্রায়ে। পরবর্তীতে ভারত সরকারকে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ঐসব অঞ্চলকে আয়ত্তে আনতে হয়েছে। সেরকমই তিনটি ঘটনা আজকের লেখায় তুলে ধরা হলো।

হায়দ্রাবাদ: অপারেশন পোলো (১৯৪৮)

অপারেশন পোলো: হায়দ্রাবাদের পথে ভারতীয় ট্যাংক। source: LIFE magazine

হায়দ্রাবাদ ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার রাজধানী হলেও এটি ছিল নিজাম বংশ শাসিত একটি স্বাধীন রাজ্য। ‘৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগের পূর্বেও বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। স্বাধীনতার পর এসব রাজ্যকে নবগঠিত পাকিস্তান বা ভারতের যেকোনো একটিতে যোগদানের সুযোগ দেয়া হয় অথবা কিছু ক্ষেত্রে নিজেরাই স্বাধীন থাকার সুযোগ ছিল।

তৎকালীন শাসক নিজাম উসমান আলী খান (৭ম নিজাম) ভারত বা পাকিস্তান দুটোর কোনটিতেই যোগদান না করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে চাইলেন। এজন্য তিনি ব্রিটিশ এবং ভারত সরকারের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু ভারত সরকার এই আবেদন প্রত্যাখান করে। হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি চতুর্দিক থেকে ভারত কর্তৃক আবদ্ধ ছিল, এর কোনো সমুদ্রসীমা ছিল না। ফলে এরকম একটি রাষ্ট্র গঠিত হলে সেটা উভয়ের জন্যেই সুবিধাজনক নয়। তাছাড়া মুসলিম শাসক দ্বারা শাসিত হলেও এর জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল হিন্দু।

অপারেশন পোলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী; source: LIFE magazine

এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার প্যাটেল হায়দ্রাবাদকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেন। ‘অপারেশন পোলো’ নামে সামরিক অভিযান ঘোষণা করা হয় এজন্য। বিখ্যাত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৫ ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য এবং একটি আর্মার্ড স্কোয়াড্রন (ট্যাংক) নিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে হায়দ্রাবাদ আক্রমণ শুরু হয়। পাঁচ দিন ধরে চলা যুদ্ধে হায়দ্রাবাদ সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর নিজাম উসমান আলী খান রেডিওতে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন।

হায়দ্রাবাদের জেনারেল সৈয়দ আহমেদ আল ইদ্রিস আত্মসমর্পণ করছেন জেনারেল জয়ন্তের কাছে; source: LIFE magazine

হায়দ্রাবাদ আর্মি চিফ মেজর জেনারেল সৈয়দ আহমেদ আল ইদ্রিস তার ২৪,০০০ সৈন্য নিয়ে জেনারেল জয়ন্ত নাথের কাছে আত্মসমর্ণ করেন। যুদ্ধে প্রায় ২৭,০০০ থেকে ৪০,০০০ সেনা মারা যায় বলে যুদ্ধের পরে গঠিত একটি কমিটির রিপোর্টে জানা যায়।

গোয়া: অপারেশন বিজয় (১৯৬১)

‘অপারেশন বিজয়’ শেষে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পর্তুগিজ বাহিনীর আত্মসমর্পণ; source: bharat-rakshak.com

বৈচিত্রে ভরা ভারতের ইতিহাসও বৈচিত্রময়। স্বাধীন ভারতের এক কোনে ‘গোয়া’ নামক অঞ্চল পর্তুগালের উপনিবেশ বা কলোনি হিসেবে থেকে গিয়েছিলো ভারত স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও, ১৯৬১ সালের অপারেশন বিজয়ের আগে পর্যন্ত এটা ছিল পর্তুগালের অংশ। শুরুটা ছিল ১৪৯৮ সালে ভাস্কো ডা গামার ভারতে আগমনের মধ্য দিয়ে, এই সূত্র ধরেই গোয়াতে পর্তুগিজ শাসনের শুরু হয়। ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ৩৬ ঘণ্টার সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ভারতে পর্তুগালের ৪৫১ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

১৯২৮ সালে প্রথম স্থানীয় অধিবাসীরা ৪০০ বছরের বিদেশি শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন আরো চাঙ্গা হয়ে ওঠে যখন জহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোসের মতো জাতীয় পর্যায়ের নেতারা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকলে পর্তুগীজ সরকার ১৯৫০ সালের দিকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে।

১৯৫৫ সালের ১৫ আগষ্ট তিন থাকে পাঁচ হাজার অহিংস আন্দোলনকারী গোয়াতে প্রবেশের চেষ্টা করলে পর্তুগিজ পুলিশ সশস্ত্র বাধা দেয়। ফলে ২১ থেকে ৩০ জনের মতো আন্দোলনকারী মারা গেলে জনমত পর্তুগালের বিপক্ষে চলে যেতে থাকে। ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর পর্তুগিজ আর্মি ‘সবরমাতী’ নামে একটি যাত্রীবাহী জাহাজকে সামরিক জাহাজ মনে করে হামলা চালালে জাহাজের প্রধান প্রকৌশলী মারা যান। এই ঘটনার পরে সম্ভাব্য ভারতীয় সামরিক অভিযানের প্রতি জনসমর্থন চলে আসে।

গোয়াতে পর্তুগিজদের রণশক্তি ছিল ভারতীয়দের তুলনায় খুবই দুর্বল। তাদের ছিল ৪,০০০ সৈন্য, সাথে ২টি হালকা আর্টিলারি ব্যাটারি। এছাড়া পর্তুগাল নেভির ছিল একটি যুদ্ধজাহাজ ‘NPR Afonso’ এবং তিনটি হালকা পেট্রলবোট। ‘ডাবলিম বিমানবন্দরে’ পর্তুগাল এয়ারফোর্সের কোনো উপস্থিতি ছিল না। শুধু একজন এয়ারফোর্স অফিসার সেখানে কর্মরত ছিলেন ‘এয়ার এ্যাডভাইসর’ হিসেবে। যুদ্ধ শুরুর সাথেই সাথেই পর্তুগালের মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ড থেকে আরো যুদ্ধ জাহাজ, জঙ্গী বিমান পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

INS Vikrant থেকে বিমানবাহিনীর যাত্রা, ডানে বিমান হামলায় বিধ্বস্ত ডাবলিম বিমানবন্দর; source: goaholidayguide

১৯৬১ সালে ১৭ ডিসেম্বর পর্তুগিজ রেকি গ্রুপের (গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ) সাথে গোলাগুলির মধ্য দিয়ে মূল সামরিক সংঘাত শুরু হয়। সেনা, নৌ আর বিমানবাহিনীর সম্মিলিত অংশ ছিল এই অপারেশনে। ১৮ ডিসেম্বর ভোরে ভারতীয় বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ করে ডাবলিম বিমানবন্দরের রানওয়ে অকেজো করে দেয় পর্তুগিজ বিমান বাহিনীর সম্ভাব্য অবতরণ ঠেকাতে।

ভারতীয় ও পর্তুগিজ জেনারেলদের মধ্যে আলোচনা এবং সব শেষে আত্মসমর্পণ; source: goaholidayguide

এরপর মেজর জেনারেল কেপি ক্যান্ডিথের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশাল দল তিন দিক থেকে গোয়া আক্রমণ করে। খণ্ড খণ্ড আকারে গোয়ার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধজাহাজ ‘NPR Afonso’ ভারতীয় নেভির সাথে গোলা বিনিময়ে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, নাবিকদের ৫ জন মারা যায়, ১৩ জন আহত হয়। বিমানবাহিনীর উপর্যুপুরি বোমা হামলায় পর্তুগিজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে ১৯ ডিসেম্বর বেলা ১২টায় আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধে ৩০ পর্তুগিজ সেনা এবং ২২ ভারতীয় সেনা মারা যায়।

সিকিম অন্তর্ভুক্তি (১৯৭৫)

সিকিম রাজপ্রাসাদের সামনে প্রহরারত সিকিম গার্ড; source: sikkimarchives.gov.in

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার সময় সিকিমের রাজা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয় যে, সিকিম স্বাধীন অবস্থায় থাকবে। ব্রিটিশরাও ভারতের কাছে এই প্রস্তাবনা দিয়ে গিয়েছিল। জহরলাল নেহেরুর শাসনামলে সিকিমকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি গণভোট হলে সেটিতে সিকিমের জনগণ স্বাধীন থাকার পক্ষেই রায় দেয়। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সিকিমকে ‘Protectorate Status’ বা আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়ে সিকিমের রাজা থাসি নামগয়ালের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুসারে সিকিমের সামরিক প্রতিরক্ষা, কূটনীতি এবং যোগাযোগের দায়িত্ব ভারত গ্রহণ করে।

১৯৬২ সালে ‘নাথুলা’ পাসে ভারতীয়-চীনা সেনাদের যুদ্ধংদেহী অবস্থান; source: Fb.com/Vintage.Sikkim

১৯৬২ সালে ভারত এবং চীনের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐ সময় যদিও সিকিম স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল, তারপরেও সিকিমের ভেতরকার ‘নাথুলা পাস’, যেটি ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের একটা শাখা, সেখানে ভারত ও চীনের সীমান্তরক্ষীদের ভেতর গোলযোগ হয়। তখন গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। মূলত চীন-ভারত যুদ্ধের পর সামরিক কৌশলগত দিক থেকে সিকিমের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

১৯৬৩ সালে থাসি নামগয়ালের মৃত্যু এবং ১৯৬৪ সালে জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর ফলে Protectorate Status এর চুক্তি কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যায়। কারণ থাসির ছেলে থন্ডুপ নামগয়াল সিংহাসনে বসলে রাজতন্ত্র বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তি চালু রাখতে চাচ্ছিলেন না। ১৯৭০ সালে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি রাজতন্ত্রের অবসান চেয়ে ভোটের দাবি জানায়।

সিকিমের রাস্তায় মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনা; source: Fb.com/Vintage.Sikkim

১৯৭০ সালে রাজতন্ত্র বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে ভারত সিকিমে সেনা মোতায়েন করে। এদিকে ১৯৭৩ সালেই সিকিমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় জটিলতা দেখা দেয়। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ৯ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনী সিকিম রাজপ্রাসাদে সামরিক অভিযান চালায়। প্রায় ৩০০ সিকিম গার্ড প্রাসাদ পাহারা দিত। গার্ডদের সাথে গোলাগুলিতে একজন ভারতীয় এবং একজন সিকিম গার্ড নিহত হয়। ভারতীয় সেনারা সমস্ত গার্ডকে নিরস্ত্র করে এবং রাজা থন্ডুপ নামগয়ালকে গ্রেপ্তার করে।

সিকিমকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সিকিম ভ্রমণ; source: Fb.com/Vintage.Sikkim

এরপর ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ভারতীয় সংবিধানের ৩৬ অ্যামেন্ডমেন্টের মাধ্যমে সিকিম ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মধ্য দিয়েই ‘৪৭ সালের পর থেকে ভারতের অভ্যন্তরে স্বাধীন হিসেবে থেকে যাওয়া সমস্ত রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নভুক্ত হয়। এরপরও ভারত সরকার প্রতিনিয়ত নকশাল আন্দোলন, মাওবাদী আন্দোলন, তামিল গেরিলা বিদ্রোহ, পাঞ্জাবের শিখ বিদ্রোহ এবং কাশ্মীর সীমান্ত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সামরিক অভিযান চালিয়েছে এবং এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু প্রকৃতিগত দিক থেকে এই তিনটি ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। শুরু থেকেই নানা ভাষা, সংষ্কৃতি আর বহুত্ববাদ নিয়েই ভারতকে টিকে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এই তিনটি অভিযানের মাধ্যমে ভারতের মানচিত্রে পরিবর্তন এসেছে।