দৈনিক সমাজের কন্ঠ

খিলজি নন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেন হিন্দুরাজা অর্জুন

ধ্বংশপ্রাপ্ত বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (ফাইল ছবি)

ডা. শাহরিয়ার আহমেদ – ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নামে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংশের অপপ্রচার ও একটি সঠিক ইতিহাস – বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। আর বখতিয়ার খিলজি বাংলায় আসেন ১২০৪ সালে, সে কি করে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংশ করলো তা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবে।১১৯৩ সালে নালন্দা যার হাতে ধ্বংস হয়েছিল তিনি হচ্ছেন তীরহুতের হিন্দুরাজা অর্জুন, যার দায় চাপানো হয় মহান মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির উপর।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন খিলজি, যিনি এই ভূখন্ড়ে গোড়াপত্তন করেছিলেন বিশাল এক মুসলিম সালাতানাতের (১২০৩-১৮৫৭)
এই মহান মুজাহিদের বাল্যকাল সম্বন্ধে আর্তুগুল গাজীর মতই তেমন কিছু জানা যায়নি।তবে যে সময় মালিক খলজী যুদ্ধের ময়দানে সময় কাটাচ্ছে, আর্তুগুল গাজী তখন নিতান্তই বালক। তুর্কিদের খলজী সম্প্রদায়ভুক্ত মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী আফগানের দশতই মার্গোতে জন্ম নেন। গজনী সুলতান গিয়াসউদ্দিন উদ্দিন মুহাম্মাদের আমলে তার ছোট ভাই মুইজ উদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লি জয় করে কুতুবউদ্দিন আইবেককে শাসক নিযুক্ত করে গজনী ফিরে যান।
বাংলায় তখন কর্ণাটক থেকে আগত সেনদের রাজত্বকাল।
এমনি একটা সময়ে জীবিকান্বেষণে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার পা রাখেন হিন্দুস্থানে।দুর্ধর্ষ যোদ্ধা কিন্তু কর্পদকহীন খর্বাকৃতির মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার সুলতান ঘুরী বা তার দিল্লি প্রতিনিধি আইবেকের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হননি।কারো কাছে চাকরি না পেয়ে অবশেষে অযোধ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হুসাম উদ্দীনের কাছে উপস্থিত হন, মালিক হুসাম উদ্দীন তাঁকে ঠিকই চিনেছিলেন। আলাউদ্দীন কায়কোবাদের মতো তিনি খলজিকে অযোধ্যার পূর্বসীমান্তের, ভিউলি ও ভগতের জায়গীর হিশেবে নিয়োগ দেন। এখান থেকেই শুরু হয় মালিক খলজীর উত্থান। ;
মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের ‘সগুত’এর পাশে তখন হিন্দুদের বাইজান্টাইন ‘ বিহার রাজ্য’ তিনি সেখানে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে অনেক ধনসম্পদ হস্তগত করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি ওদন্তপুরী বিহার জয় করে নেন,প্রাপ্ত ধনরত্ন নিয়ে তিনি কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে হাজির হন।আইবেক তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করেন।পরের বছর সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি (১২০৩/১২০৪) এ তিনি লক্ষ্মণসেনের নদীয়া আক্রমণ করেন।নদীয়ায় তখন অবস্থান করছিলেন বৃদ্ধ লক্ষ্মণসেন,বিনাবাধায় নগরে প্রবেশ করে প্রাসাদ দ্বারে গিয়ে হাজির হন।লক্ষ্মণসেন তখন মধাহ্নভোজে বসেছিলেন। খবর শুনে খাবার ফেলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে চলে যান।এভাবেই মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার নদীয়া জয় সম্পন্ন করেন,এই জয়ের ফলে লক্ষ্মণসেনের বিপুল ধনসম্পদ তাঁর হস্তগত হয়।;
লক্ষণসেন রাজ্য ত্যাগ না করে বিশাল রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত তেলিয়াগড় গিরিখাত দিয়ে সৈন্য পরিচালনা করেন, কারণ এটিই ছিল পশ্চিম দিক থেকে এদেশে অভিযানের সম্ভাব্য পথ। কিন্তু আল ফাতিহর মতো লক্ষ্মণসেনকে বোকা বানিয়ে ঝাড়খন্ডের দূর্গম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেন-সেনাবহিনীর অলক্ষ্যে নদীয়ায় পৌঁছে যান।ফলে বিনা যুদ্ধে পুরো নদীয়া তার হস্তগত হয়। এদেশে সূচিত হয় এক বিশাল মুসলিম সালাতানাতের। তিনদিন ধরে নদীয়ার নিয়ন্ত্রণ সুসম্পন্ন করে নদীয়া থেকে চলে এসে তিনি লক্ষ্মণানতী (গৌড়)অধিকার করেন অতি সহজে।এখানে স্থাপন করেন তাঁর রাজধানী। লক্ষ্মণাবতী পরিণত হয় লখনৌতিতে।;
নদীয়া জয়ের পর তিনি স্থানীয় অধীবাসীদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালান,নারী শিশুর আহাজারিও তাঁর পাষাণ হৃদয়ে দাগ কাটেনি। মুসলিমরা যে কতোটা বর্বর এটাই তার বাস্তব প্রমাণ।
সবচাইতে বড় আঘাতটা হানেন হিন্দুদের পরমযত্নে গড়ে তোলা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মানমন্দির নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। বিদ্যালয় ভবনগুলো তিনি গুড়িয়ে দেন।লাইব্রেরীতে আগুন ধরিয়ে দিলে বইয়ের অধিক্যে তা পুরোপুরি ভস্মীভূত হতে প্রায় ছয় মাসের মতো সময় লাগে! বর্তমানে নালন্দার গেইটে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে, সর্বশেষ ১২০৩ সালে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের হাতে এটি ধ্বংস হয়!
হিন্দু এবং সেকুলাঙ্গার ঐতিহাসিকেরা বঙ্গবিজয়ী এই মহান মুজাহিদকে বিতর্কিত করতে যে অপবাদগুলো দেয় এগুলো তার অন্যতম। সাধারন মুসলমানরাও এদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হয়ে বঙ্গবিজয়ী এই মহান মুজাহিদ সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকেন
এখন আসুন দেখা যাক এগুলোর সত্যতা কতটুকু..
১: ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত তৎকালীন নদিয়া ছিলো হিন্দুদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান। এখানে বসবাস ছিল হিন্দু এলিট শ্রেণীর, লক্ষ্মণসেন নিজের শেষ সময়টা কাটানোর জন্য এটি বেচে নেন।অধীবাসীদের বেশিরভাগই ছিলো ব্রাহ্মণ,এদের চরিত্র সম্বন্ধে বলার প্রয়োজন মনে করছিনা। খলজীর নদীয়া আক্রমণের প্রায় বছর দুয়েক আগেই এরা সুযোগ বুঝে পালাতে থাকে,কারণ খলজীর প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে এরা অবগত ছিল। খলজী নদীয়া আক্রমণ করেন পশ্চিম সীমান্তের ঝাড়খন্ডের দূর্গম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।তো ভাই এই দূর্গম জঙ্গলের ভিতর খলজী গণহত্যা কার উপর চালিয়েছেন.. গাছের উপর.!! তিনি যখন মূল শহরে প্রবেশ করেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলো মাত্র ১৭ জন!যদিও ধরেনিই এই সতেরো জন সৈন্য নিয়েই তিনি গণহত্যা চালাচ্ছিলেন,তখন হিন্দু মহাবীরেরা কি করছিল..! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যেমন তাদের কাছে নেই,তাদের দাবি করা অভিযোগগুলোর বিষয়েও তাদের কাছে কোন ঐতিহাসিক দলীল নেই।
২: বিহারে অবস্থিত নালন্দা কিন্তু হিন্দুদের কোন মানমন্দির নয়,এটি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে বৌদ্ধদের দ্বারা,এটা পরিচালিতও হতো বৌদ্ধদের দ্বারা।
নালন্দা মোট তিনবার আক্রান্ত হয়।
প্রথম আক্রমণের শিকার হয় প্রতিষ্ঠার একশত বছরের মধ্যে হুনদের দ্বারা।
দ্বিতীয় আক্রমণের শিকার হয় হিন্দুদের মহারাজা শশাঙ্কের হাতে।
ঐতিহাসিক ডিডি গোস্বামী এ সম্পর্কে বলেন,,সর্বপ্রথম এই মহাবিহারের উপর আক্রমণ আসে শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্তের দ্বারা। তার বৌদ্ধ বিদ্বেষ এতোটাই তীব্র ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে গাঙ্গেয় উপদ্বীপ দখল বৌদ্ধ অনুরুক্ত হর্ষবর্ধনকে হত্যার করার পর বোধিবৃক্ষকে উপড়ে নদীতে ফেলে দেন, বৌদ্ধের পদচিহ্ন ধ্বংস করেন।নালন্দার প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন তিনি,চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ্গের আগমনের সময়ও নালন্দা তার দৈন্যদশা থেকে বের হতে পারে নি।;
তৃতীয় আক্রমণ হয় এক বহিঃশত্রু দ্বারা ১১৯৩ সালে, এই সময় নালন্দা পুরোপুরি ভস্মীভূত করা হয়। এই আক্রমণের সময়কাল নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এখন আসুন, খলজীর দিকে ফিরে যায়।হিন্দু রাজঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের ভাষায়,খলজী হিন্দুস্থানে আসেন ১১৯৫ সালে,হুসাম উদ্দীনের কাছে কাজ পান ১১৯৬ সালে, উদন্তপুরী বিহার আক্রমণ করেন ১১৯৯ সালে,ইরফান হাবিবের ভাষ্যমতে ১১৯৯ সালে দক্ষিণ বিহারে অভিযান চালিয়ে খলজী গোবিন্দপালকে পরাজিত করেন। নালন্দা থেকে এর দূরত্ব প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার, তাবাকাতে নাসিরিতে যে টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণদের হত্যা এবং মন্দির ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে, এটি হচ্ছে মূলত বৌদ্ধদের এই উদন্তপুরী বিহার,খলজী দূর্গ ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে এটি আক্রমণ করেন,যা ছিল লক্ষণসেনেরই চাল। ;
যদুনাথ সরকারের মতে খলজীর বাংলা আক্রমণ ছিলো ১২০১ সালে।এখানে সবচেয়ে মজার বিষয়টি হচ্ছে সকল ঐতিহাসিকের দাবি অনুযায়ী খলজী বঙ্গবিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ ই মে।অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে
নালন্দাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। যে লোকটি বাংলায় আসেন ১২০৪ সালে,সে কি করে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করলো তা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবে। ১১৯৩ সালে নালন্দা যার হাতে ধ্বংস হয়েছিল তিনি হচ্ছেন তীরহুতের হিন্দুরাজা অর্জুন, যার দায় চাপানো হয় মহান মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির উপর।
নদীয়া জয়ের পর খলজী আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ আইবেকের কাছে মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান।পুরস্কার হিশেবে খলজীকে দেয়া হয় নির্বিঘ্নে রাজ্য শাসনের নিশ্চয়তা। খলজী জীবিত থাকাকালীন আইবেক লখনৌতিতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। এরপর তিনি রাজ্যশাসনে মনোনিবেশ করেন। মুহাম্মদ ঘুরীর নামে খুৎবা পাঠ এবং মুদ্রা জারি করেন। তাই মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যটির বা গজনী সালতানাতের অনুগত এই প্রদেশটির প্রথম শাসনকর্তা।
এখন আসুন, খলজী’কে দেয়া আরো কিছু অপবাদ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করি…
১ঃ বিদেশী আক্রমণকারী- তুর্কিদের খলজী গোত্রের মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজিকে হিন্দু ঐতিহাসিকেরা প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করে। আসলেই কি খলজীই প্রথম বিদেশী,যিনি বাংলা আক্রমণ করেন…!
উত্তর :— এ দাবিটা সম্পূর্ণ ভুয়া। বৈদিক যুগের শেষদিকে হিন্দু আর্যরা প্রথম বাংলা আক্রমণ করেন,তবে তারা সফল না হলেও ব্রাক্ষণরা বাংলায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে, এবং বাংলার অধিবাসীদের উপর জাতপাত প্রথা চাপিয়ে দেন।
এরপর বাংলা আক্রমণ করে অবাঙ্গালী গুপ্ত হিন্দুরা,বৌদ্ধদের উপর নির্যাতনের ফলে একসময়ের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা হয়ে উঠে হিন্দুদের অভয়ারণ্য। হুনদের আক্রমণে গুপ্তদের যখন পতন ঘটে বাংলা দখল করেন কর্ণাট দেশ থেকে আগত হিন্দু সেনরা,বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার যথারীতি চলতে থাকে।;
২:–খলজিকে দেয়া আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি নাকি গণহারে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেন এবং যারা অস্বীকার করে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করেন।
এই অভিযোগটিও সম্পূর্ণ ভূয়া। খলজীর আগমনের অনেক আগেই এদেশে সুফি-দরবেশদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন ঘটে।এসব সুফিদের মধ্যে অন্যতম পান্ডুয়ার সুফি শেখ তাবরীজি এবং তাঁর শিষ্যরা।তাদের আচরণে আকৃষ্ট হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু মুসলিম জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। আমরা যদি খলজীর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী মেচ সম্প্রদায়ের ইসলাম গ্রহণের দিকে তাকাই, খলজিকে দেয়া এই অপবাদটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে। দলীলের ভিত্তিতে বাংলার প্রথম ইসলাম গ্রহনকারীদের সম্পর্কে জানতে এটা দেখুন…
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ যখন দেবকোটে আনা হয় স্থানীয়দের আহাজারি, সমাহিত করার পর তাঁর সম্মানে দীর্ঘদিন মাটিতে ঘুমানোর দ্বারা প্রমাণিত হয় এই অভিযোগটি মুসলিম বিদ্বেষীদের দেয়া অপবাদ বৈকি কিছুই না।
৩:–এই অভিযোগটি খোদ একশ্রেণির কথিত মুসলমানদের মধ্যেও দেখা যায়!! তিনি বাংলা আক্রমণ করলেন কেন.,এসবের কি দরকার ছিল..?
উত্তর:- সেসব কুলাংগারদের জেনে রাখা উচিত।কেয়ামতের ময়দানে প্রত্যেক মুসলমানকেই তাঁর প্রতিবেশী অমুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, আশপাশের অমুসলিমদের সে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিল কিনা.? তিনি যদি বাংলা আক্রমণ না করতেন আমরা এখনো কুফরীতেই লিপ্ত থাকতাম,নিজেরা নামে মুসলিম পরিচয়টাও দিতে পারতাম কিনা সন্দেহ..!! তাঁর বাংলা আক্রমণের কারণ হিশেবে ধরতে গেলে প্রথমত স্থানীয় মুসলমানদের উপর হিন্দুদের অত্যাচার,এর পর আসে ইসলাম সম্পর্কে এই ভুখন্ডের অধীবাসীদের আগ্রহ, যদি তা না হতো তাঁর আক্রমণের সময় গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠতো,তা না হওয়ায় বুঝা যায় তারা এই অভিযানকে খুশিমনেই নিয়েছিলো। দ্বিতীয়ত হিন্দুদের হাতে নির্যাতিত বৌদ্ধদের আমন্ত্রণ। রাজ্যবিস্তার একজন বীরের সহজাত প্রবৃত্তি,আর খলজী ছিলেন একজন সেনানায়ক এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। রাষ্ট্রিয়ভাবে বাঙ্গালীদের উপর হিন্দুধর্ম চাপিয়ে দেয়া সম্রাট অশোক,নালন্দা ধ্বংসকারী শশাঙ্ক যদি হিন্দুদের কাছে বীর হয়,উন্নত চরিত্র দিয়ে ইসলাম প্রচারকারী মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি আমাদের কাছে হওয়া দরকার ছিলো মহাবীর।কিন্তু আফসোস, শতকরা ৯০% মুসলমান তাঁকে লুণ্ঠনকারী হিসেবেই চিনে..!;
যাইহোক আমরা এবার লখনৌতির দিকে ফিরে যায়।
লখনৌতি রাজ্যের পূর্বে তিস্তা-করতোয়া নদী,দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর,পশ্চিমে ইবনে বখতিয়ারের পূর্ব-অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। রাজ্য সুশাসনের জন্য তিনি লখনৌতিকে তিনভাগে ভাগ করেন এবং প্রত্যেক ভাগে একজন সেনাপতি নিয়োগ দেন। এই বিভাগগুলোকে বলা হতো ‘ইকতা’ এবং এর শাসককে বলা হতো ‘মুকতা’। খলজীর সেনাপতিদের মধ্যে মাত্র তিনজনের নাম জানা যায়,এরা হচ্ছেন আলী মর্দান খিলজী, তিনি ছিলেন ‘বরসৌল'(বর্তমান দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট এলাকা) ২ঃ হুসাম উদ্দীন ইওজ খিলজি, তিনি ‘গঙ্গতরী'( খুব সম্ভব তান্ডা এলাকা)। ৩:শীরন খিলজী,তিনি ছিলেন পদ্মাতীরের সীমান্তবর্তী এলাকার মুকতা।;
কেউ যদি এটি নিয়ে সিরিয়াল তৈরী করতে চায় ‘সাদেত্তিন কোপেকে’র চরিত্রের জন্য,আলী মর্দান খিলজীই যথেষ্ট।;
শাসন ব্যবস্থা সুবিন্যাসের সাথে সাথে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি লাখনৌতি রাজ্যে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। রাজ্যের নানা স্থানে নির্মাণ করেন মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ইসলাম প্রচারক ও সুফিদের জন্য খানকাহ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটি মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা ব্যতীত লাখনৌতি রাজ্য টিকিয়ে রাখতে শুধুমাত্র সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করা বোকামি হবে। তবে এমনি একটা সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ পান্ডুয়ার সুফি হযরত শেখ তাবরিজি অনেক আগেই শুরু করেছিলেন।;
তাঁর ক্ষুদ্র রাজ্যটি প্রতিষ্ঠার পর পরেই অন্যান্য স্থান থেকে মুসলমানরা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এখানে আসতে শুরু করেন।ইবনে বখতিয়ার তাদের আগমনে উৎসাহও দিয়েছিলেন। মধ্য এশিয়ায় তখন মোঙ্গল তান্ডব তীব্র আকার ধারণ করেছে।এই চরম দূর্দিনে ইবনে বখতিয়ার তাদের লাখনৌতিতে আমন্ত্রণ জানান,তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সেখানখার বহু সুফি,বিদ্বান ব্যক্তি তার রাজ্যে আগমণ করেন।এমনকি শক্তিদ্বন্দ্বে লিপ্ত দিল্লির বহু সম্ভান্ত্র পরিবারও লাখনৌতিতে এসে বসতি স্থাপন করেন।এদের বসবাসের ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের সামাজিক কাঠামোয় ও মানসিক মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। কুসংস্কারচ্ছন্ন ও বর্ণপ্রথায় জর্জরিত স্থানীয় হিন্দু ও বৌদ্ধরা দলে দলে শামিল হতে শুরু করেন ইসলামের পতাকাতলে।;
লাখনৌতি রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইবনে বখতিয়ার ৩ বছরের বেশি সময় পান নি।তাঁর শেষ অভিযান ছিলো তিব্বত অভিযান।সমগ্র বাংলা জয় করার চেষ্টা না করে তিনি কেন সুদূর দূর্গম তিব্বত আক্রমণ করতে চেয়েছিলাম তা বোধগম্য নয়।হতে পারে, তিনি ভেবেছিলেন তিব্বতের পরই তুর্কিস্তান। পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি তুর্কিস্তানের সাথে সোজা যোগাযোগের স্থাপনের জন্য তিনি এমনটি করেছিলেন। অথবা তাঁর দুর্ধর্ষ মনোভাব একটা নতুন কিছু এবং অসম সাহসিক কিছু করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। যাই হোক এটি যে উগ্র মস্তিষ্কের পাগলামি বা হঠকারিতার পরিচায়ক নয়,সতর্কতার সাথে তিব্বত অভিযানের প্রস্তুতি তাই প্রমাণ করে।কিন্তু তিব্বত অভিযানে ব্যর্থ হয়ে অনেক সৈন্যসামন্ত হারিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি দেবকোটে অবস্থান করতে থাকেন। এখানে আরেকটা বিষয় হচ্ছে হিন্দু ঐতিহাসিকদের দাবি তিনি নাকি এসময় নালন্দায় চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন, অথচ আরেকদলের অভিযোগ তিনি তা ১২০৪ সালেই পুরোপুরি ভস্মীভূত করেন!বিপুল সেনাবাহিনী ধ্বংস হওয়ায় তিনি শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ে, যার জন্য তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।;
১২০৬ সালে সেই রোগশয্যায়ই তিনি পরপারে পাড়ি জমান(ইন্না-লিল্লাহ)। অনেকেরই সন্দেহ ঘুমের মধ্যে তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে তারই দুরাকাঙ্ক্ষী সহচর আলী মর্দান খিলজী!কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে উপমহাদেশে মুসলিমভিত্তি প্রতিষ্ঠাকারী সুলতান মুইজ উদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরীও ঝিলাম নদীর তীরে আততায়ী কর্তৃক শহীদ হন,বিক্রমপুরে পালিয়ে আসা লক্ষ্মণসেনও মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে দুরাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীর এক নির্মম ফুৎকারে নিভে যায় ইসলামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দীপশিখা। অবশ্যই নিভে গেল নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করেই। উচ্চতায় খাটো হলেও মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার এমন এক সেনাপতি যাঁর সাহস,উদ্যম ও নেতৃত্বের তুলনা মেলা ভার।ময়দানে তিনি যেমন ছিলেন দক্ষ সেনানায়ক, প্রশাসক হিশেবেও তেমন দক্ষ। রণক্ষেত্রে দুর্জয় ও রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায়ও এই মর্দে মুজাহিদ ছিলেন সদা তৎপর।;
অস্পষ্ট পরিচয় এক তুর্কী সন্তান তখনকার শক্তিস্তম্ভ সুলতান ঘুরী বা দিল্লি-প্রধান আইবেকের কোনরকমের সহায়তা ছাড়াই মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে যান এমন এক রাজ্য,গুরুত্বে যা অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে দাঁড়ায় পরাক্রমশালী দিল্লি সালতানাতের ঈর্ষার ব্যাপার।
#শেষকথাঃ দিনাজপুরে তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর কবর পাওয়া গেছে, হয়তোবা তাঁর কবরটিও এখানে থাকতে পারে।দিনাজপুরের কারো চোখে পোস্টটি পড়লে নক করার অনুরোধ রইল। তাঁকে নিয়ে হিন্দুরা যতটা ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছে, উপমহাদেশের অন্য কোন মুসলিম শাসকের বেলায় তা দেখা যায় না। তাদের এসব অপপ্রচারের জবাব এবং এই মহান মুজাহিদকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস যেন আমার নাজাতের উসিলা হয়।আল্লাহ তায়া’লা মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির সকল অপরাধ ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতবাসী করুক। আমিন।
সহায়িকা
মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা
আসকার ইবনে শাইখ
দ্যা হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল
শ্রী দীনেশচন্দ্র।
বাংলার ইতিহাস আদিপর্ব
নিহাররঞ্জন রায়।
বাংলার ইতিহাস, সুলতানী আমল
ড. আবদুল করিম।
হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল
কালিকা রঞ্জন কানুনগো
প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৭১
তথ্য সংগ্রহে ডা. শাহরিয়ার আহমেদ