ডা. শাহরিয়ার আহমেদ – প্রাচীন ঢাকার ’ভিস্তিওয়ালা’দের ইতিহাস। চৌসার যুদ্ধে শের শাহের আক্রমণে ডুবতে বসা সম্রাট হুমায়ূনকে বাঁচিয়েছিল এক ভিস্তিওয়ালা, তখন সে সম্রাটকে চিনতে পারেনি, সম্রাট হুমায়ুন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ভিস্তিওয়ালকে ওয়াদা করেছিল তিনি ফিরে গিয়ে তাকে একদিনের সম্রাট বানাবেন, এতে ভিস্তিওয়ালা মনে করেছিল এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম। পরে সম্রাট ফিরে গিয়ে ভিস্তিওয়ালাকে ডেকে ওয়াদা অনুসারে একদিনের জন্য ক্ষমতায় বসান।বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের আনাগোনা ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানীর বেশ অভাব। ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতোই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হতো খাল, নদী বা কুয়ার ওপর। একই পদ্ধতি ছিল কলকাতা শহরেও, যা এখনো চোখে পড়ে।
নিরাপদ পানির জন্য তাই শহর অধিবাসীদের অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতে হতো। ঢাকার নাগরিকদের নিরাপদ পানির জন্য সাধারণত শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির ওপর নির্ভর করতে হতো। শহরে যেসব কুয়া ছিল তাতেও ছিল সুপেয় পানীর অভাব। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী লোকরা তাই এক বিশেষ পেশাজীবী শ্রেণির লোকদের মাধ্যমে নিজেদের পানি সংগ্রহ করতেন।
তাদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার এক মশক। এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। এদের বলা হতো ভিস্তি বা সুক্কা। ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁক দিয়ে প্রতি বাড়ি গিয়ে তারা পানি দিয়ে আসত। ১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০টি ভিস্তিপল্লীর উল্লেখ করেছিলেন। ঢাকার ভিস্তিরা থাকত সাধারণত পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি। স্থানীয়রা ভিস্তিদের বলত সাক্কা। কালক্রমে এই সাক্কা সিক্কাতে পরিণত হয়ে সিক্কাটুলি পাড়ায় রূপ নিয়ে হারিয়ে যাওয়া ভিস্তিওয়ালাদের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এসব ভিস্তিরা ছিল সুন্নি মুসলিম। মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার রাখার দায়িত্বে তাদের প্রত্যক্ষ করা যেত। দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান খ্যাত বিশেষ এ পেশাজীবী শ্রেণিদের মধ্যে নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হতো নবাব ভিস্তি। বিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় একজন ভিস্তি ১০ থেকে ২০ টাকার বিনিময়ে এক মশক পানি সরবরাহ করে দিত।
বাংলা সাহিত্যেও ভিস্তিওয়ালাঃ
প্রথিতযশা সব কবি সাহিত্যিকদের রচনায় ভিস্তিদের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায়৷ শামসুর রাহমান তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ভিস্তিদের চিত্রায়িত করেছেন এভাবে, “রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। কালো মোষের পেটের মত ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসির ভেতর৷ মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা”
সুকুমার রায় তাঁর ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়? ছড়ায় ভিস্তিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।
লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?”
এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা
ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিস্কার কবিতায়ও ভিস্তিওয়ালাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক, একুশ লাখ ভিস্তি
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।