সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (বিএসএমএমইউ) এর আইসিইউতে মৃত্যু মানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থাটাই প্রকাশ করে। দেশের সকল হাসপাতাল থেকে আসার পর এখানে এসে মৃত্যুবরণ করে। তাই এখানে মৃত্যুটা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে যে, যারা মৃত্যুবরণ করছে, তাদের শরীরে পাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলোর ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই অধিকাংশ এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স থেকে। এটা হচ্ছে আমাদের জন্য ভয়ংকর খবর। তাহলে সারা দেশজুড়েই এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের অবস্থাটা খুবই খারাপ।
ধারাবাহিকভাবেই গত ১৫ বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের এন্টিবায়োটিক ধীরে ধীরে কমে আসছে। যে এন্টিবায়োটিকগুলো ৫ থেকে ১০ বছর আগে খুবই কার্যকর ছিল, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই কাজ করছে না।
মূলত যে বিষয়টা লক্ষণীয় সেটা হলো, বাংলাদেশে প্রায় দুই-আড়াই লক্ষ ফার্মেসি আছে, এই দুই-আড়াই লক্ষ ফার্মেসি যদি একদিনে অন্তত ৫টি করে এন্টিবায়োটিক দেয়, তাহলে দেখা যায় যে, প্রতিদিন তারা ১০ থেকে ১৫ লক্ষ এন্টিবায়োটিক দেয়, যার মধ্যে খুব অল্প একটা অংশের সত্যিকারের প্রয়োজন। একজন দোকানদারের পক্ষে কোন এন্টিবায়োটিকটা সত্যিকারের প্রয়োজন, কোনটার প্রয়োজন নেই, এটা বুঝার সুযোগ নাই। এসব নিয়ে তারা কিছুই জানে না।
প্রতিদিন প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে অপ্রয়োজনে বা ভুল এন্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে, এরকম একটা দেশে এন্টিবায়োটিক ডেভেলপ করাটা খুব স্বাভাবিক। এর সাথে আবার যোগ হয়েছে যে, প্রতিদিন সকালবেলা প্রায় ১৫-২০ কোটি মুরগিকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে।
দেখা যায় যে,মুরগীকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কোনো প্রয়োজন নাই। অথচ মুরগী যাতে নিরাপদে থাকে সেজন্য তার শরীরেরও এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। আর তাদের শরীর থেকে মাটিতে, পানিতে সে এন্টিবায়োটিক যাচ্ছে, সেখান থেকে সেই এন্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়ার কাছে চিঠির মতো জেনেটিক ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছে!
এরপরে যে অঞ্চলে এভাবে মুরগীকে খাওয়ানো হচ্ছে এন্টিবায়োটিক, ওই ব্যাকটেরিয়ার ট্রান্সফার জিন দিয়ে আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়াগুলো পরবর্তীতে যখন মানুষকে আক্রমণ করছে, তখন ওই ওষুধ এবং ওই ওষুধের মতো অন্যান্য ওষুধ আর কাজ করছে না। এটা একটা ভয়ংকর চিত্র।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপারটা হচ্ছে, যিনি রেজিস্টেন্স হলেন, তিনি যেখানেই থাকুক, এই আক্রান্ত মানুষটা তো মুভ (চলাফেরা) করছে। সেই সাথে ব্যাকটেরিয়াও মুভ করছে।
আমেরিকার একজন মানুষ যদি এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাহলে তার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষও আক্রান্ত হতে পারে, আবার বাংলাদেশের কোন মানুষ যদি এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাহলে তার মাধ্যমে আমেরিকার মানুষও আক্রান্ত হতে পারে।
অতএব আমরা যখন একজন মানুষকে চিকিৎসা করছি, দোকানদার যিনি ওষুধ বিক্রি করছে, যে নিজে নিজেই ওষুধ খাচ্ছেন, সে শুধু নিজেকেই ঝুঁকিগ্রস্ত করছেন না। আশপাশের মানুষকেই নয় শুধু, সমস্ত পৃথিবীকেই ঝুঁকিগ্রস্ত করে তুলছেন।
দুই.
কিছু মানুষ আছে যারা ডাক্তারদের কাছে আসার আগেই নিজের মতো করে কিছু ওষুধ খেয়ে আসে। ডাক্তার এ বিষয়টা যখন বুঝতে পারেন তখন আর তিনি ঝুঁকি নিতে চান না। এটাই হলো বাস্তবতা। এটা আসলেই যুক্তিযুক্ত ধারণ না। কারণ, আসলেই যে মানুষটি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, সেই ব্যাকটেরিয়াটি সত্যি সত্যিই এই ওষুধের রেজিস্টেন্স কিনা, আমাকে পরেরটায় যেতে হবে কিনা।
বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনক সত্যটা হচ্ছে, আমাদের ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র ১০/১২টা জেলায় শুধুমাত্র সেনসিটিভিটি টেস্ট করানো যায়। এটা ভাবাই যায় না। এর ফলে দেশের হাসপাতালগুলোর বিরাট একটা অংশের এই সেনসিভিটি সম্পর্কে কোন ধারণাই নাই। যে দেশের ৫২/৫৪ জেলায় সেনসিটিভিটির কি আছে না আছে আজ পর্যন্ত জানি না, সেখানে ডাক্তারকে ধারণা ভিত্তিক চিকিৎসা করতে হয়।
সেই ধারাণাটা তার বই থেকে পাওয়া ধারণা, ক্লাস থেকে পাওয়া ধারণা। ওরা তো জানে না চারপাশে কি সিনসিটিভিটি। এখন এন্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে তো সেই ধারনা প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় চেঞ্জ হয়।
সেখানে ওনি ক্লাসরুমে পড়া ধারণ দিয়ে চিকিৎসা করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওনি কম ঝুঁকি নিতে চান। এই ক্ষেত্রে অনেক সময় তিনি বেশি মাত্রার বেশি দামি ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ দেয়া হয়ে যাচ্ছে।
এটার থেকে প্রতিকারের পদ্ধতি হলো, প্রথমতই বাংলাদেশে জুড়ে একটা ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক থাকতে হবে যেন আমাদের এন্টিবায়োটিকগুলো রেজিস্টেন্সি সম্পর্কে ধারণা থাকতে পারে। সেই ধারণা শুধু ল্যাবরেটরিতেই থাকলে হবে না।
ঢাকা শহরে তো সকল ল্যাবরেটরিতেই সেনসিটিভিটি করা হচ্ছে, কিন্তু এই ধারণা কি ডাক্তারের কাছে পৌঁছাচ্ছে? তা তো না। তার মানে এগুলো মানুষকে জানাতে হবে।
আমি মনে করি এটা বাধ্যতামূলক করা দরকার যে, ল্যাবরেটরিগুলোর সেনসিটিভিটি প্রকাশ করতে হবে। রাষ্ট্রকে এটা এনালাইসিস করে সকল ডাক্তারদের জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এবং সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে চট্রগ্রামের যে সেনসিটিভিটি রাজশাহীর তো সেরকম না, এই ব্যাপারগুলো জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর সেটার ভিত্তিতে ডাক্তারদের জন্য একটা গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।
ডাক্তাররা সেগুলো জানবেন, মানুষজন সেগুলো জানবেন, আর সে অনুযায়ীই রোগীদের প্রেসক্রাইব করতে হবে।
তাহলেই আমরা এই যে বলছি, রেজিস্টার ডাক্তার ছাড়া কারো প্রেসক্রিপশনে এন্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা যাবে না, এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
আমাদের উচিত হবে এই ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ককে প্রতিষ্ঠিত করা এবং যাদের ল্যারেটরি আছে তাদেরকে বাধ্য করা তাদের সেনসিটিভিটি নাম গোপন করে রাষ্ট্রকে জানাতে হবে। রাষ্ট্রের এ ব্যপারে উদ্যোগী হতে হবে।
তিন.
আমরা একটি সরকারি আদেশ চাই যে, সকল ওষুধের প্যাকেট থেকে লাল রং সরিয়ে দিবেন। শুধুমাত্র লাল রং থাকবে এন্টিবায়োটিক ওষুধের প্যাকেটের গায়ে।
মিডিয়াগুলো শুধু বাংলাদেশের মানুষকে বলে দেবেন, লাল রংয়ের ওষুধগুলো খাওয়ার সময় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
দোকান খুলে ফার্মেসিওয়ালা বসে থাকুক বা বিক্রির চেষ্টা করুক, মানুষ সেটা এমনিতেই কিনবে না। এটা হচ্ছে সবচেয়ে সহজ সমাধান। মিডিয়াগুলো শুধুমাত্র এই কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। সরকার ওষুধ প্রশাসনের উপর একটি আদেশ জারি করবে। তাহলেই একমাত্র এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
Medivoice –