ক্রিকেট কর্তাদের সীমাহীন সেচ্চাচারিতায় হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার কিছু ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেট ক্লাব

0
0

ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ একাবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ঢাকার লীগে একটি নতুন ক্লাবের আবির্ভাব ঘটে। তখনকার তরুণ মোহাম্মাদ আশরাফুল সহ একাধিক ক্রিকেটার এই ক্লাবের হয়ে খেলেছিলো। বলা হতো এই দলটা নাকি বড় দলকে নাকচুবানী দিতো। একটা তরুণ ফ্যানবেজ তৈরি করেছিলো দলটি। ভাবা হচ্ছিলো ডিপিএলে রাজত্ব করতে এসেছে দলটি। কিন্তু আজ দলটি কোথায়?

সূর্যতরুণ দলটি সবশেষ প্রিমিয়ার লীগে খেলেছে ২০১২ সালে। অর্থাৎ ঢাকা লীগের লিষ্ট এ মর্যাদা পাবার এক বছর আগে। তারপর থেকে পতনের শুরু। সবশেষ এবছর তারা সেকেন্ড ডিভিশনে খেলেছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। সুর্যতরুনের ক্রিকেট দলটি থাকলে ইস্কাটন সবুজ সংঘের তাও নেই৷ একসময় যে ক্লাবের হয়ে খেলেছিলো মেহেদী মিরাজ, মেহেরাব হোসেন অপি, শাহরিয়ার বিদ্যুৎ সহ একাধিক ক্রিকেটাররা।

কিন্তু প্রশ্নটা জাগে কেনো হারিয়ে যাচ্ছে এই ক্লাবগুলো৷ আর কারাই বা নিচ্ছে এই ক্লাবগুলোর জায়গা? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে বিসিবির একটি অন্ধকার গলির দেখা মিলবে, যেখানে আলো দেখানোর কোনো পথই নেই।

সেই ইস্কাটন সবুজ সংঘের কাছেই ফেরা যাক। ইস্কাটন সবশেষ কবে কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলেছে তার কোনো তথ্য না পাওয়া যায়নি। তবে এই ক্লাবের কর্তাদের দাবি তারা টিকতে পারেনি ক্রিকেট পলিটিক্সের সামনে৷

ইস্কাটন সবুজ সংঘের সাধারণ সম্পাদক মেহেদুল ইসলাম বাসেত ২০২১ সালে মাছরাঙ্গা নামক একটি বেসরকারি চ্যানেলকে বলেন, “ক্রিকেটে হওয়া রাজনীতিই আমাদেরকে থামিয়ে দিয়েছে। আমরা খেলা শুরুর আগেই বুঝে যেতাম যে ম্যাচের ফলাফল কি হবে। আম্পায়াররা আমাদের সরাসরি বলে দিতো, আমরা এসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছি। আমরাও বুঝে যায় কাউকে কিছু বলে লাভ নেই৷ কারণ বললে আমাদের উপরই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

প্রশ্নটা হলো কেনো এমনটা হচ্ছে, আর এর প্রভাবটা কতটা ভয়ানক আমাদের ক্রিকেটে।

উত্তরটা হলো ক্ষমতা। এই কারণেই বর্তমানে ক্লাবগুলোকে একে একে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। রুখে দেওয়া হচ্ছে নতুন ক্লাবের আসার সম্ভাবনা। ফলাফল, এখন জাতীয় দলেও আসে না কোনো মানসম্পন্ন ক্রিকেটার।

সবশেষ ২০১২ সালে ৩য় বিভাগ ক্রিকেটের বাছাই পর্বে খেলেছিলো ৮৪টি দল। কারণ তখন এন্ট্রি ফি ছিলো মাত্র ৫০০০ টাকা। কিন্তু ২০১৩ মৌসুমে সেই এন্ট্রি ফি বাড়িয়ে করা হয় ১ লাখ টাকা। তাতে দল আসে মাত্র ১৪টি। ২০১৪-১৫ মৌসুমে সেই নিবন্ধন ফি আবারও বাড়ানো হয়। করা হয় ৫ লাখ টাকা। দেওয়া হয় নতুন নতুন সব শর্ত। সেসব শর্তগুলো হলো:

– সমাজকল্যান অধিদপ্তরের নিবন্ধন থাকতে হবে
– ঢাকার ক্লাব হতে হবে
– স্থায়ী ঠিকানা থাকতে হবে
– রেজিস্টার্ড কোনো ক্রিকেটার থাকা যাবে না

তবে শর্ত পুরণের পরও অনেক ক্লাবকে এন্ট্রি করানো হয়নি। তাহলে ৩য় বিভাগে খেলছে কারা?

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ৩য় বিভাগে খেলছে বোর্ডকর্তাদের বানানো কিছু ক্লাব। এমনই একটি ক্লাব হলো নাখালপাড়া ক্রিকেটার্স। উপরের বর্ণিত শর্ত পূরণতো দূরে থাক, তাদের নেই নিজেদের কোনো ক্রিকেট দলও। মাছরাঙ্গা টিভির একটি অনুসন্ধানে জানা যায় কেরানীগঞ্জের একটি স্থানীয় একাডেমির কিছু ক্রিকেটার নিয়ে চলছে তাদের কার্যক্রম। আরেক ক্লাব কালিন্দি ক্রিকেট একাডেমির অবস্থা আরও বেহাল। আবাহানীর ইন্ডোরে চলে তাদের প্রাক্টিস। আরও অবাক করা ব্যাপার, এই ক্লাবের সাইনবোর্ডে আছেন সিসিডিএমের সদস্য সচিব আলী হোসনে।

শুধু এটাই নয়, যারা রেজিস্টার্ড ক্লাব, পুরণ করেছে বিসিবির সব শর্ত, রয়েছে নিজেদের জায়গা তাদের খেলাটা আরও বড়। একটু এবারের প্রিমিয়ার লীগটাই দেখা যাক। শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব আর আবাহানী ক্রিকেট ক্লাবের মিল কোথায় জানেন? দুটোতেই রয়েছে বেক্সিমকোর কর্মকর্তারা। বিসিবির পরিচালকের তালিকা দেখলে দেখা যায় অন্তত ৪-৫ জন যুক্ত আছে বেক্সিমকোর সাথে। শুধু বেক্সিমকো না, জেমকন গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, গাজী গ্রুপ সহ অসংখ্য কোম্পানীর সাথে যুক্ত কর্মকর্তারাও বিসিবিতে যুক্ত আছেন৷ কারণ তাদের হাতে ক্লাব রয়েছে, ফলে তাদের কাউন্সিলররা আছে বিসিবিতে। ফলাফল, বিসিবির পরিচালক হিসাবেও রয়েছেন তারা।

ক্রিকেটের অনেক সংগঠকদের মতে মূলত বোর্ড কর্তাদের পছন্দের কিছু ক্লাবকে সুবিধা দিতে এবং ভোট ব্যাংকে আধিপত্য রাখতে এই কাজটি করেছে। কিভাবে তা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে বিসিবি নির্বাচন কিভাবে হয়।

বিসিবির নির্বাচন আইসিসির নিয়মে হয়ে থাকে। এই নির্বাচন হয় ৩ ক্যাটাগরিতে।

প্রথম ক্যাটাগরিতে ভোট দিতে পারবে বিভাগ ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার মনোনীত ৭১ জন কাউন্সিলররা। ৭ বিভাগের একেকটি বিভাগ থেকে অন্তত ১ জন পরিচালক আসে। ১০ জন পরিচালক প্রথম ক্যাটাগরি থেকে আসে।

দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে ভোট দিতে পারবে ক্লাবগুলো। এই ক্যাটাগরিটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্যাটাগরি। ঢাকার প্রিমিয়ার, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগের দলের ৫৮ জন মনোনীত হয়। তাদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হয়ে আসবেন ১২ জন প্রতিনিধি।

তৃতীয় ক্যাটাগরিতে ভোট দেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সব সার্ভিসেস, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাবোর্ড, বিকেএসপি ও কোয়াব মনোনীতরা। এই ক্যাটাগরিতে আসবেন একজনই।

১ম ও ৩য় ক্যাটাগরিতে ক্লাবগুলো সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকলেও ২য় ক্যাটাগরিতে ক্লাবগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপ আছে। আর তাই এই ক্যাটাগরিতে যেনো নিজের দল ভারী করা যায়, তার জন্য বিসিবির কর্তাদের এই পন্থা। তাতে যে শুধু বিসিবিতে পছন্দের পরিচালক বসবে তাই না, অনেক ক্ষেত্রে নেওয়া যাবে সুযোগ সুবিধাও। আর তাই ক্লাবগুলোর ভোট হাতে রাখতে বিসিবির কর্তারাও বানানো শুরু করেছে ভুইফোড় ক্লাবগুলো। কারণ ভালো ক্লাবগুলো সুযোগ পেলে বিসিবিতে একটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে। তাতে গদি হারাবেন অনেকেই। তা কিভাবে হতে এএয় রাঘব বোয়ালেরা।

আর এভাবেই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে ক্লাবগুলোকে। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক ক্লাব আর একাডেমি।

একটি অনুসন্ধান বলছে গত ১০ বছরে অন্তত সাড়ে পাচ হাজার ক্রিকেটার নিজেদের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পায়নি। বাংলাদেশের এজ লেভেলের ভালো স্ট্রাকচার থাকার জন্য হয়তবা জাতীয় দলে এতটা প্রভাব এখন পড়ছে না। কিন্তু তা যে আজীবন এমন থাকবে এমনটা কখনই বলা যাচ্ছে না। বেশ কয় বছর ধরে প্রিমিয়ার লীগে পার্ফরম করা ক্রিকেটাররা সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। কারণ লীগে ক্রিকেটারের সংকট তৈরি হয়েছে। আর তাই ডিপিএলে রেকর্ড হাজার রান করার পরও এনামূল হক বিজয় তামিল নাড়ুর লোকাল ক্রিকেটারদের বিপক্ষেও এ দলের হয়ে বাজে খেলেছেন। অনেক ক্রিকেটার ক্ষুব্ধ হয়ে ছেড়েছেন ক্রিকেট। মাঝে মাঝে ক্রিকেটাররা ক্ষুব্ধ হয়ে এমন এমন কাজ করেছে যা হয়েছে খবরের টপিকও। ২০১৭ সালেতো নো-বল কান্ড হয়েছিলো আন্তর্জাতিক হেডলাইন। এভাবে চললে খুব বেশী দিন নেই, যেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট তার সবচাইতে খারাপ সময়টা পাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here