আজ ঐতিহাসিক ‘বদর দিবস‘

0
0
ছবি - দি ম্যাসেজ মুভি থেকে নেওয়া
লিয়াকত আলী – সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্দেশক গ্রন্থ আল কুরআনুল কারিম নাজিলের মাস রমজানুল মোবারক। আজ ১৭ই রমজান। রমজান মাসের আজকের দিনটি অসাধারণ তাৎপর্যের অধিকারী। আজ ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরি দ্বিতীয় সনের সতের রমজান মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ব ও তাঁর পাঠানো রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মুষ্টিমেয় দলের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াই।

তাতে মানুষের সব ধারণা নাকচ করে দিয়ে প্রায় উপকরণহীন মুষ্টিমেয় দলটিকে জয়ী করেন মহান রাব্বুল আলামিন। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। তাই শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এ দিন অনন্য অবস্থান দখল করে রেখেছে।

বিশ্বমানবকে মুক্তি ও কল্যাণের শাশ্বত বাণী শোনাতে এবং দিশেহারা বনি আদমকে সত্য সুন্দর পথের সন্ধান দেয়ার জন্য ধূলির ধরায় তাশরিফ এনেছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠ হাবিব আখেরি নবী রহমাতুল লিল আলামিন; কিন্তু তার প্রচারিত ইসলামের বাণী মক্কায় তের বছর ধরে তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি স্থানীয় কুরাইশদের বিরোধিতার কারণে।

এ দিকে ইয়াসরিব পল্লী থেকে বায়তুল্লাহর জিয়ারতে আসা আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা তাতে সহজেই আকৃষ্ট হন এবং বিশ্বাস স্থাপন করেন। তারা জন্মভূমিতে নির্যাতিত ইসলামের নবী ও তার অনুসারীদের আহ্বান জানান নিজেদের জনপদে। আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা সেখানে হিজরত করতে থাকেন।

আল্লাহর নবীও একপর্যায়ে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে হিজরত করলেন। নবীর শুভাগমনে ইয়াসরিবের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন নবী বা সংক্ষেপে মদিনা। নতুন জনপদটি হয়ে উঠল ইসলাম প্রচার ও প্রসারের নিরাপদ কেন্দ্র। মুসলমান হয়ে যাওয়া আওস-খাজরাজ গোত্রের সাথে বনু কায়নুকা, বনু নজির, বনু কুরায়জা ইত্যাদি ইহুদি গোত্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রচিত হয় মদিনা সনদ নামে পরিচিত পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র।

কিন্তু মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের শান্তিতে থাকতে দিতে চায়নি। তারা ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। ছোটখাটো হামলাও চালাতে থাকে। এত দিন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুসলমানদের শুধু ধৈর্যধারণের আদেশ করা হয়েছিল। এবার সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি নিয়ে নাজিল হলো কুরআন মাজিদের কয়েকটি আয়াত। যেমন সূরা হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হলো- যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে, তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হলো এ জন্য যে, তারা নির্যাতিত হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। তাদেরকে নিজেদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের প্রভু আল্লাহ।

এভাবে সশস্ত্র পন্থায় কাফেরদের প্রতিরোধ করার অনুমতি লাভের পর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রস্তুত হলেন। কুরাইশ কাফেরদের সাথে আল্লাহর নবী ও তার সাথীদের কয়েকটি ছোটখাটো সংঘর্ষের পর প্রথম সরাসরি সশস্ত্র মোকাবেলা হয় মদিনা থেকে বেশ দূরে বদর প্রান্তরে; কিন্তু দুই পক্ষে কোনো দিক দিয়েই সমতা ছিল না। আল্লাহর নবীর সাথে মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ। তারা প্রায় নিরস্ত্র। অপরপক্ষে আবু জেহেলের নেতৃত্বে রয়েছে এক হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী।

লড়াই শুরুর আগে আল্লাহর নবী দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ, তুমি যদি চাও দুনিয়াতে তোমার ইবাদত করার কেউ না থাকুক, তাহলে এই ক্ষুদ্র দলটিকে নিশ্চিহ্নহ্ন হতে দাও। আল্লাহ তা চাননি। আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় ছিল বাহ্যিক ও উপকরণগত শক্তির অসারতা প্রমাণ করা। তাই প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় মুজাহিদের কাছে পরাজিত হয় সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী।

কুরাইশদের দর্প চূর্ণ হয়। তাদের পক্ষে নিহত হয় ৭০ জন। বন্দী হয় আরো ৭০ জন। আর মুসলমানদের মধ্যে শহীদ হন মাত্র ১৪ জন। যুদ্ধের এ ধরনের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ অভাবনীয়; কিন্তু তা ছিল আল্লাহর কুদরতের নমুনা। তিনি স্বল্পসংখ্যক মানুষকে বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী করে দেখিয়ে দিলেন অবিশ্বাসী লোকদের প্রকৃত দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব।

তাই বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ জিহাদ। যুদ্ধবন্দীদের সাথে আল্লাহর নবী ও মুসলিমরা যে সহমর্মিতার আচরণ করেন, বিশ্বের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া মুশকিল। মুক্তিপণ আদায়ে অক্ষমদের ওপর দেয়া হয়েছিল ১০ জন মুসলিম শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব। শিক্ষার প্রতি ইসলামে কত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তারও প্রমাণ এই ঘটনা। বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের জন্য এতে রয়েছে গভীর ও ব্যাপক শিক্ষা। বিশ্বসভ্যতার মোড় ঘুরে যায় এ থেকে।

বদর প্রান্তরে যেমন মক্কার পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা জয়ী হয়েছিলেন, তেমনি একই সময়ে সমকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে চলমান লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল রোমান শক্তি। অগ্নিপূজারী পারস্য শক্তির বিরুদ্ধে রোমান খ্রিষ্টান শক্তির বিজয়ের খবরও ছিল মুসলমানদের জন্য প্রেরণার বিষয়।

পৌত্তলিকতাসহ বিভিন্ন অসার ভাবধারা মানবজাতিকে আশরাফুল মাখলুকাতের উন্নত মর্যাদা থেকে নামিয়ে এনেছিল সবচেয়ে নিচু স্তরে। ইসলাম মানবজাতিকে আবার সেই উন্নত মাকামে নেয়ার ঘোষণা দেয়। বদরের প্রান্তর থেকে ইসলামের বিজয়ধারা সূচিত হয়। তাই প্রতি বছর সতেরই রমজান মুসলিম উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস, নতুনভাবে প্রত্যয় জাগায় খোদায়ি কুদরতের অসীমতার সামনে নিজের সব কামনা বিলীন করে দেয়ার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here