ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ ওষুধের এক্সপায়ার ডেট বা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বলতে কী বোঝায়? কোনো ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কীভাবে নির্ধারণ করা হয় বা তা কতটুকু সততা ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়? আর আসলে কি ওষুধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর নষ্ট হয়ে যায়? ধরুন আপনি প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভুগছেন।
আপনি খুঁজতে গিয়ে ড্রয়ারে দেখলেন প্যারাসিটামল রয়েছে যার মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এক বছর আগে পার হয়ে গেছে। আপনি এখন কী করবেন? আপনি কি এই ওষুধ খাবেন, না খাবেন না।
খেলেও কি সেটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে? বা তার কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হবেন? আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন? আপনি মারা যাবেন বা নিদেনপক্ষে আপনার মাথাব্যথা সারবে না? এ ধরনের প্রশ্ন প্রায় সকল মানুষের মনে সৃষ্টি হয় ফলে মানুষের মনে নানা ধরনের সংশয় ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
আসলে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে এত বিভ্রান্তির কোনো কারণ নেই, আতঙ্কেরও কোনো কারণ নেই। কারণ নাইট্রোগ্লিসারিন, ইনসুলিন, তরল অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কিছু সংবেদনশীল ওষুধ ছাড়া বেশিরভাগ ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পরও কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা অনেকদিন ঠিক থাকে।
একবার যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অনুরোধে এফডিএ একটি গবেষণা চালায়। সেনাবাহিনীকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খুব দামি ওষুধ সংরক্ষণ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের এ ওষুধ ধ্বংস করে ফেলতে হয়, ফলে অঙ্কের অর্থ গচ্ছা যায় রাষ্ট্রের। বিশাল এই অঙ্কের অর্থ বাচাতে কিছু করা যায় কিনা, তা দেখা ছিল সেই গবেষণার মুল উদ্দেশ্য। গবেষণায় দেখা যায়, ১০০টিরও বেশি ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) ও প্রেসক্রিপশন ড্রাগের ৯০ শতাংশ ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার ১৫ বছর পরও কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা ঠিক পাওয়া গিয়েছিল।
এরকম আরও অনেকগুলি গবেষণায় ঠিক একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়।
মার্শাল অ্যালেন ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই প্রোপাব্লিকায় দ্য মিথ অব ড্রাগ এক্সপাইরেশন নামে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধটি তিনি শুরু করেন এভাবে- এফডিএ বছরের পর বছর ধরে কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার দিক থেকে বেশিরভাগ ওষুধ একদম ঠিক থাকার তথ্য জানা সত্ত্বেও হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোকে প্রতিবছর মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করে ফেলতে হয়; এটা বিবেচনা না করে যে, এসব ওষুধ কত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল।
আরও একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা হলো, একটি কালো আলমারিতে ১৪ পদের প্রেসক্রিপশন ড্রাগের একটি বাক্স ভুলে ফেলে রাখা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের দিকে। এর মধ্যে আরও ছিল অ্যানটিহিস্টামিন, ব্যথানাশক, উদ্দীপক জাতীয় ওষুধ। মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার প্রায় ৩০ বছর পর এ ওষুধ খুঁজে পাওয়া যায়।
ভাবা হয়েছিল, ওষুধগুলো নষ্ট বা বিষাক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু লী কানট্রেল ও রয় গেরনা নামের দুই গবেষক ৩০ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া এ ওষুধ পরীক্ষা করে দেখতে পান- এসব ওষুধের সক্রিয় উপাদান পারফেক্টলি ঠিক আছে এবং কার্যকারিতাও নষ্ট হয়নি। ওষুধগুলো ছিল মূল বা আসল সিল দেয়া পাত্রে। পরীক্ষার ফলাফলে তারা হতবাক হয়ে যান।
ঠাণ্ডা জায়গা যেমন রেফ্রিজারেটরে ও নির্দেশিত পরিবেশে রাখা হলে ওষুধের কার্যকারিতা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পরও বহু বছর অক্ষুণ্ণ থাকে।
এখানে কোথাও না কোথাও গলদ বা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে এবং আমরা এও কি ধরে নিতে পারি, কোনো কোনো ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর গ্রহণ কার্যকারিতা বা নিরাপত্তার দিক থেকে ভয়ের কিছু নেই?
তবে উল্লিখিত সংবেদনশীল ওষুধগুলো এবং অ্যান্টিবায়োটিকসহ আরও কিছু ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর গ্রহণ করা হলে, কার্যকারিতা না পেলে সংক্রামক রোগসহ কিছু জটিল রোগ না সারার ব্যাপারে কারও মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাই মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করাই উত্তম।
ওপরের ঘটনাগুলো ও তার ফলাফল আমাদের কী বলে? মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার ৩০ বছর বা ১৫ বছর পর ওষুধ ঠিক থাকে কীভাবে? ওপরের গবেষণা সত্য ও বিজ্ঞানসম্মত- এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে অধিকাংশ ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এত কম হয় কেন?
আরও প্রশ্ন হল- কোম্পানিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংসের পরিবর্তে এফডিএ ও প্রতিরক্ষা বিভাগ কর্তৃক গৃহীত শেলফ লাইফ এক্সটেনশন প্রোগ্রাম (Shelf Life Extension Program) মোতাবেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অক্ষুণ্ণ গুণগত মানের ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ বর্ধিত করে বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে কিনা?
নাকি তারা ইচ্ছে করেই ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কম রেখে ওষুধের কাটতি ও মুনাফা বাড়াতে চায়? এ নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময় এসেছে।