ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা, একাকী এরদোয়ান ও বৈশ্বিক পর্যালোচনা

0
0

ডেস্ক নিউজঃ আপনার যদি মনে হয়েই থাকে, এরদোয়ান ফাঁকা বুলির একজন মানুষ ব্যতীত আর কিছুই নয়, তবে এই লেখাটা সম্পূর্ণ আপনার জন্য। আর যদি বিশ্বাস করেন, এরদোয়ান যা করছে তা যথেষ্ট না, তবে কিছুটা হলেও বাস্তব উপযোগী, তবে লেখাটি আপনার বিশ্বাসে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিতে পারে।

সবার আগে দেখা যাক, বর্তমান ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী কে তার দিকে। জোট গঠনের শর্ত হিসেবে বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেফতালি বেনেট। যাকে নিয়ে সংক্ষেপে বলতে হলে বলা চলে তিনি নেতানিয়াহু থেকে কোন অংশে কম নন। কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশিই আগ্রাসী। যার প্রমাণ মিলেছে ক্ষমতা গ্রহণের একদিনের মাথায়। কেবল বেলুন দেখেই গাজায় তার নির্দেশে চালানো হয়েছে হামলা।

বেনেটের আগে ক্ষমতায় ছিলেন নেতানিয়াহু। মুসলিম বিশ্বের প্রায় সবার কাছেই যিনি ছিলেন খলনায়কের মত এক চরিত্র। ক্ষমতার একেবারে শেষ প্রান্তে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত জেরে গাজায় ব্যাপক আকারে হামলা চালায় তার প্রশাসন। এতে নিহত হয় আড়াইশ এর বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক। ১১ দিনের এই আগ্রাসী হামলার সময়ে একাধিকবার ইসরায়েলকে দেখে নেয়ার কিংবা আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। তবে তাকে সামরিক কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এবং বড় ধরনের হুমকির মাঝেই মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে যায় হামাস এবং ইসরায়েল।

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নেটিজেন মহলে এরদোয়ান সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বেশিরভাগেরই ইচ্ছে ছিল, তুরস্ক সরাসরি সামরিক আক্রমণ করুক। ইসরায়েল ধরাশায়ী হোক, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আবেগের বশে বাংলাদেশে বসে যতখানি বলা সম্ভব, তা কি আসলেই করা সম্ভব? আসুন তলিয়ে দেখি।

আরব বিশ্ব এবং এরদোয়ান…
সবার আগে ধরতে হয়, মুসলিম বিশ্বের বৈশ্বিক সংস্থা ওআইসি এর কথা। যেখানে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরান, জর্ডান, কুয়েতের মত সব দেশই আছে। এতগুলো দেশের এই বৈশ্বিক সংস্থা মূলত তৈরিই হয়েছিল মসজিদে আল আকসাকে রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে। কিন্তু তার সুফল কি পেয়েছে? একটা নিন্দা প্রস্তাবও সংস্থা থেকে দেয়া সম্ভব হয়নি। সেদিক থেকে তুরস্ক যা কিছু প্রতিবাদ সরাসরি করতে পেরেছে, তার জন্য এরদোয়ান অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার।

এবার আসা যাক সামরিক আক্রমণের দিক থেকে। সত্যি বলতে ন্যাটোর সবচেয়ে শক্তিশালী কিছু সামরিক শক্তির কথা বলা হলে তার মাঝে তুরস্ক দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় অবস্থানে থাকবে। তবে এও মনে রাখা দরকার, তুরস্ক যতখানি অস্ত্র নিজ দেশে তৈরি করে, ঠিক ততখানি অস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয় করেছে। আর ক্রয় করা অস্ত্রে অন্য দেশে আক্রমণ করতে হলে বিক্রেতা দেশটির অনুমতি দরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি কখনো তুরস্ককে ইসরায়েল আক্রমণের অনুমতি দিবে? ভেবে দেখা দরকার।

মনে রাখা দরকার, একমাত্র ফিলিস্তিন ইস্যুতেই তুরস্কের সব রাজনৈতিক দল তাদের পার্লামেন্টে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। সারা তুরস্কে মানুষ করোনার লকডাউনকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছে, মিছিল করছে।

সামরিক শক্তিতেও এরদোয়ান একা…!
এখানে আরেকটা বিষয় বলা দরকার। ইসরায়েলকে আক্রমণ করা মানে কোনভাবেই একক একটি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করা নয়। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, ফ্রান্স এমনকি ভারতের মত রাষ্ট্রও জড়িয়ে যাবে। এরা প্রত্যেকেই ইসরায়েলের যথেষ্ট বড় মিত্রশক্তি। এবার নজর দেয়া যাক মুসলিম বিশ্বের সামরিক শক্তির দিকে।

বাস্তবতা অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক দিক থেকে ইসরাইলের ওপরে আক্রমণ করতে পারবে এরকম একটি মাত্রই দেশ আছে, সেটা হচ্ছে ইরান। কারণ ইরান একমাত্র রাষ্ট্র যারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিজেদের অস্ত্রে সামরিক বাহিনী পরিচালনা করে। তবে শিয়া সুন্নি বিতর্কের জেরে ইরান ঠিক কতখানি আক্রমণাত্মক হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এ কারণেই তুরস্ক এবং ইরান এক হতে পারেনি।

আরব বিশ্বে সৌদি আরবের প্রচুর অস্ত্র আছে। একইসঙ্গে আরব আমিরাত, মিশর এবং কাতারের প্রচুর অস্ত্র আছে। যা নিয়ে একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভব। তবে মনে রাখা দরকার, এদের বেশিরভাগ অস্ত্র এবং প্রযুক্তি আসে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ব্রাজিল কিংবা ফ্রান্স থেকে। যারা ইসরায়েলের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরার অনুমতিই দিবে না। তবে সিরিয়া, ইয়েমেন কিংবা লিবিয়ায় এই অস্ত্রগুলো দিয়ে আক্রমণ করার অনুমতি আসলেই আছে।

এবার আসা যাক তুরস্কের কথায়। তুরস্কের ব্যাপক অস্ত্র থাকলেও তা দিয়ে এককভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট না। ইসরায়েলের মিত্রপক্ষের কথা বাদই দেয়া হোক। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি দেশের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালানোর জন্য যে পরিমাণ ভারি অস্ত্র-শস্ত্র দরকার সে তুলনায় তুরস্কের নিজস্ব তৈরি অস্ত্রের পরিমাণ খুবই কম।

তুরস্ক থেকে সরাসরি ইসরায়েলে আক্রমণ করতে হলে বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী ব্যবহার করা যাবে। অথচ তুরস্কের এই দুটি বাহিনীকেই এরদোয়ান পূর্ববর্তী শাসকরা দূর্বল করে রেখেছেন। আর তুরস্কের যুদ্ধ বিমানগুলোর প্রায় সবই আমেরিকা থেকে কেনা। একইসঙ্গে বলতে হয়, তুরস্কের কোন বিমানবাহী রণতরী নেই যা দিয়ে ভূমধ্যসাগরে ফিলিস্তিনের তীরে গিয়ে আক্রমণ চালানো সম্ভব। আর তুরস্ক থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে ইসরায়েলে বিমান হামলা চালানো খুব সহজ একটি কাজ না।

আর ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, মিসরের মত দেশগুলো আগেই মার্কিন হস্তক্ষেপে দিশেহারা। এরদোয়ান তাই এমন এক সমীকরণে দাঁড়িয়ে যেখানে তাকে লড়তে হবে একা এবং তাতে পরাজয় সময়ের ব্যাপার। এরদোয়ান মিত্র হিসেবে পারমাণবিক শক্তিধর একমাত্র দেশ হিসেবে পাশে পেতে পারতেন পাকিস্তানকে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তান যদি ইসরায়েল বিরোধী একটা পদক্ষেপ নেয়, তবে কাশ্মীর সীমান্তে ভারত চুপ থাকবেনা। এরদোয়ানের পক্ষে তাই সবচে বড় অবলম্বন ছিল ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাওয়া।

এরদোয়ানের ফলাফল তবে শুন্য…?
যদি বলা হয়, এরদোয়ান কি তবে একেবারেই ব্যর্থ? উত্তরটা হবে ‘না’। একটা খুব সাধারণ ভাষায় বলা যাক, ফুটবল মাঠে এগারজনই গোল করেন না। এগারজনই গোল সেইভ করেন না। একজন থাকেন, যিনি অদৃশ্য নাটাই হাতে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়ার মত কাজ করেন। এরদোয়ান ঠিক তাই করেছেন।

রাশিয়ায় পুতিনকে ফোন করে জনমত তৈরির চেষ্টা, ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাওয়া, জো বাইডেনকে সরাসরি আক্রমণাত্মক কথা বলা… এরদোয়ান ছিলেন ফুটবল মাঠের সেই মাঝমাঠের খেলোয়াড়ের মত, যিনি সরাসরি আক্রমণে না গিয়েও ইসরায়েলের বিপক্ষে জনমত আর হুমকি দিয়ে চাপে ফেলার কাজ করেছেন।

একটা কথা বলে রাখা দরকার, লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ কিংবা গাজার হামাসের পক্ষে আক্রমণ করা বেশ সহজ ছিল। কিন্তু একজন এরদোয়ানের পক্ষে সেটা কখনোই সহজ না। এরদোয়ানের আক্রমণ করার একমাত্র অর্থ ছিল সমগ্র তুরস্ককে বিপদে ফেলা। আবেগের বশে অনেক কিছুই নেট দুনিয়ায় লেখা সম্ভব। কিন্তু সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রনেতা হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দূরহ কাজের একটি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here