মোঃ রায়হান – আজ ৪ঠা এপ্রিল যশোরের গণহত্যা দিবস। এই দিনে নির্মমভাবে শহীদ হন অর্ধশতাধিক মানুষ। আজ ৪ঠা এপ্রিল মহান মুক্তিযুদ্ধের যশোরের ইতিহাসের নৃশংসতম দিন; যশোরের গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রাককালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন অর্ধশতাধিক মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এদিন পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন যশোরের রাজনীতিক, শিক্ষক, ছাত্র ও পেশাজীবী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। এই দেশটির অভ্যুদয়ের ৪৮ বছর পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ওই দিন প্রাণ বিলিয়ে দেয়া যশোরের ৫১ শহীদ। ওই শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, ৪ এপ্রিল যশোরের শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের স্মরণে স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। তাহলে তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে পারবে নতুন প্রজন্ম। সূত্র মতে, সারাদেশের মত যশোরেও ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধপ্রস্তুতি। আর এপ্রিলের শুরু থেকেই গোটা বাঙালি জাতি পুরোদমে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতিতে মাঠে নেমে পড়ে। এই যুদ্ধপ্রস্তুতিকে থামিয়ে দিতে নৃশংস হয়ে ওঠে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। এ সময় যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাক আর্মি শহরের বিভিন্ন স্থানে চালাতে থাকে বর্বরোচিত হামলা। যশোরে তাদের সবচেয়ে নৃশংসতম হামলার ঘটনাগুলোর অনেকগুলোই ঘটে ৪ এপ্রিল। এদিন যশোর ক্য্যান্টনমেন্টের পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মধ্যযুগীয় তা-ব চালায়। প্রকাশ্যে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে এদিন তারা হত্যা করে অর্ধশতাধিক বাঙালিকে। এদিন সবচেয়ে বড় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে। সেদিনের সেই নারকীয় তান্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রেলস্টেশন এলাকার শেখ আব্দুর রহিম জানান, ৪ এপ্রিল ভোরে শহরের রেলস্টেশন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ফজরের নামাজ শেষ করে কোরআন শরীফ পাঠ করছিলেন। এমন সময় স্থানীয় বিহারীদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তান্ডব চালায়। মাদ্রাসার বড় হুজুর আবুল হাসান যশোরী পাক আর্মিদেরকে নিরস্ত করতে গেলে অবাঙালিরা পাক আর্মিদের জানায়, ‘এরা সবাই ইপিআর; পাকিস্তানের শত্রু।’ এরপরই পাক আর্মি নির্বিচারে গুলি চালায়। মাদ্রাসা প্রাচীরের উপর থেকে এই দৃশ্য দেখে পালিয়ে যান আব্দুর রহিম। পরে দুপুরের দিকে তিনি এবং তার ভাই জাহাঙ্গীর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এসে দেখেন রক্তে ভেসে যাওয়া গোটা অঞ্চলে শুধু লাশ আর লাশ। এখানেই পাওয়ায় ২৩ জনের মৃতদেহ। এদের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকি ৭জনের পরিচয় আজও জানা যায়নি। মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আত্মরক্ষার জন্য খোঁড়া গর্তে রহিম ও জাহাঙ্গীর লাশগুলো একের পর এক সাজিয়ে মাটিচাপা দেন। সেদিনের নৃশংস ঘটনাটি বর্তমানে মাদ্রাসা ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। এখানে নিহতদের যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হলেন একই পরিবারের তাহের উদ্দিন, এবিএম আব্দুল হামিদ ও এবিএম কামরুজ্জামান এবং একই এলাকার কাজী আব্দুল গণি ও তার ছেলে কাজী কামরুজ্জামান। একই পরিবারের ৩ সদস্য তৎকালীন খুলনা কমিশনার অফিসের কর্মচারী দীন মোহাম্মদ, সম্মিলনী স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব হোসেন ও কাজী আব্দুল কালাম আজাদ, রেলস্টেশন মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ওরফে কাঠি হুজুর, শহীদ সাংবাদিক গোলাম মাজেদের পিতা যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ, শহর আলীর ছেলে আবু কালাম এবং মাদ্রাসার ছাত্র আতিয়ার রহমান, নোয়াব আলী, লিয়াকত আলী, মাস্টার আব্দুর রফিক ও আক্তার হোসেন। একইদিনে শহরের গুরুদাসবাবু লেনেও চলে পাক হানাদারদের নারকীয় তান্ডব। এই লেনের বাড়ি থেকে অ্যাড. সৈয়দ আমীর আলী ও তার তিন ছেলে এমএম কলেজের বিকম শেষ বর্ষের ছাত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম বকুল, বিকম শেষ বর্ষের ছাত্র সৈয়দ শফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী আজিজুল হককে পাক সেনারা ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে নির্মম নির্যাতনের পর তাদেরকে হত্যা করে। এদিনেই পাক সেনারা শহরের ক্যাথলিক গির্জায়ও আক্রমন করে। সেখানে গির্জার ইতালিয়ান ফাদার মারলো ভারনেসিসহ ৬ জনকে হত্যা করে হায়েনারা। এছাড়াও একইদিনে শহরের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তৎকালীন যশোর শহর ছাত্রলীগের সভাপতি এমএম কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এমএম কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মোছাদ্দেদ আলী, ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক, নিখিল রায়, নাসিরুল আজিজ, অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলী, তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাহ, ইপিআর সদস্য আব্দুল মান্নান, ক্রিকেটার স্বপন বিশ্বাস, ডা. নাসির উদ্দিন ও মিসেস নাসির, আব্দুর রহমান, লুৎফর রহমান, মিসেস জাবেদা লুৎফর, চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, মাহবুব এবং ভোলাট্যাংক রোডের অবসরপ্রাপ্ত সেরেস্তাদার আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এই শহীদদের পরিবারের সদস্যরা আজও সেই নির্মমতার দুঃসহ স্মৃতি বহন করে ফেরেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে এই শহীদদের কোন স্বীকৃতি না দেয়ায় তারা হতাশ। তারা এই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং নতুন প্রজন্মকে সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।