মিশরের বিখ্যাত স্ফিংক্সের কথা নিশ্চয় আপনাদের জানা আছে। সেটির তুলনায় আদতে ক্ষুদ্র হলেও গঠনে অত্যন্ত নিঁখুত এই স্ফিংক্স আপনাকে অবাক করে দিবে। পুরো শহরের পাথরগুলো মেগাথিলিক শ্রেণীর বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকগণ। হাজার বছরের পরিত্যক্ত শহর হাত্তুসার বুকে আরেক রহস্য হয়ে টিকে আছে সবুজ রঙের রহস্যময় কিছু পাথর। তবে সবচেয়ে অবাক হতে হয় পাথরের বুকে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ছিদ্রের দিকে তাকিয়ে। দেখে মনে হয়, কোনো ড্রিল মেশিনের সাহায্যে বুঝি প্রাচীনকালের মানুষেরা পাথরের বুকে সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছে। এরূপ শত শত রহস্যঘেরা প্রশ্নের জন্ম দেয়া শহর হাত্তুসা। তুরস্কের বুকে অবস্থিত এই পরিত্যক্ত নগরী খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে হিট্টাইটদের রাজধানী ছিল।
হাত্তুসা নগরীর অবস্থান এবং ইতিহাস
প্রাচীন সভ্যতায় পৃথিবীজুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হওয়া জাতিগুলোর মাঝে হিট্টাইটরা অন্যতম। হাত্তুসার বিস্তৃত ভূমিকে কেন্দ্র করে তারা বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে। ইতিহাসের ভাষ্যমতে, হিট্টাইটদের সাম্রাজ্য সুদূর বসফরাস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার বর্তমান নাম সিরিয়া। হিট্টাইটরা তৎকালীন অন্যান্য সাম্রাজ্যের সাথে বিভিন্ন কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতো। তুরস্কের বিভিন্ন ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে হিট্টাইটদের সাথে প্রাচীন ফারাওদের মিশরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। হিট্টাইটদের শক্তিমত্তার প্রমাণ পাওয়া যায় আমারনার প্রতিবেদনগুলোর মাঝে।
প্রাচীন যুগে লিপিবদ্ধ এক প্রতিবেদনে মিশরীয়রা হিট্টাইটদের শক্তিকে তৎকালীন আসেরীয়, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সাথে তুলনা করেছে। তবে হিট্টাইট জাতির উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদগণ দ্বিধায় আছেন। অনেকের মতে, হিট্টাইটরা অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে এক অঞ্চলে জড়ো হয়ে নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করেন। আবার অনেকের মতে, হিট্টাইটরা কোনো যুদ্ধবাজ জাতি। নিরীহ মানুষের ভূমি দখলের মাধ্যমে তারা তাদের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলে সত্য, গবেষকগণ স্ব স্ব তত্ত্বের পেছনে কেউই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেন নি।
হিট্টাইটদের প্রাণকেন্দ্র হাত্তুসার অবস্থান তুরস্কের নগরী বোয়াজকেলের অভ্যন্তরে। ব্রোঞ্জ যুগের শেষার্ধে হিট্টাইটরা একে নিজেদের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তখন হাত্তুসা সেই অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট নগরী ছিল। ধ্বংস হবার পূর্বে ঘন অরণ্য এবং উর্বর ভূমি সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল এই হাত্তুসা। তবে হাত্তুসার বুক চিরে বয়ে চলা নদীগুলোর নাব্যতা ছিল না। যার ফলে নদীপথে হাত্তুসার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না।
ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে হাত্তুসার প্রথম অস্তিত্ব জানা যায় আসেরীয়দের পাণ্ডুলিপি থেকে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তারা হাত্তুসার নিকটস্থ অঞ্চলে একটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিলো। একসময়ের প্রতাপশালী হিট্টাইটরা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাস থেকে। কুসারা রাজ্যের রাজা আনিত্তা ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে হাত্তুসা দখল করে নেন। কিন্তু তিনি হাত্তুসা শাসন করেননি। আনিত্তা এক অদ্ভূত কাজ করে বসেন। তিনি হাত্তুসা নগরী এবং এর বাসিন্দাদের ধ্বংস কামনা করে প্রাচীন ধর্মরীতিতে অভিসম্পাত করেন। সেই অভিশাপের ইন্দ্রজালে আবদ্ধ হাত্তুসা পরবর্তীতে এক ধ্বংসস্তূপ হিসেবে ইতিহাসের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছে। সেই হিসেবে ইতিহাসে অনেকেই হাত্তুসাকে অভিশপ্ত নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হাত্তুসার সন্ধানে অভিযাত্রীদল
হাত্তুসার পতনের পরে তা কয়েক শতাব্দী ধ্বংসস্তূপ হিসেবে তুরস্কের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। শেষপর্যন্ত ১৯০৬ সালে একদল জার্মান জ্ঞানপিপাসু অভিযাত্রী হাত্তুসা পুনরুদ্ধার করতে অগ্রসর হন। গ্রীষ্মকালীন প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানের আওতায় প্রায় একশত বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই অঞ্চলে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন অভিযাত্রীগণ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রহস্যের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। শত শত মাটির তৈরি পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন ভাষায় লিপিবদ্ধ স্মারকলিপি সহ হিট্টাইট সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। উন্মুক্ত হয়েছে বহু অজানা ইতিহাস। হাত্তুসার রহস্যময় নিদর্শনসমূহ ইতিহাসবিদদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। একে ঘিরে তৈরি হয়েছে হাজারো প্রশ্ন, যাদের অধিকাংশের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ইতিহাসবিদগণ। হাত্তুসার অধিকাংশ অঞ্চলে খনন কাজ শেষ হয়ে গেলেও, গবেষকগণ আশা করছেন, অনাবিষ্কৃত হাত্তুসার গর্ভে লুকিয়ে আছে হাজারো বছরের অজানা রহস্য।
রহস্যময় ড্রিলের ছিদ্র
হাত্তুসার ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণের পর যে কেউ চট করে বলে দিতে পারবে, এরা পাথরশিল্পে বেশ দক্ষ ছিল। এই শহরের প্রতিটি স্থাপনায় পাথরের বুকে লেগে আছে দক্ষ শ্রমিকদের সুনিপুণ ছোঁয়া। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল মন্দিরের স্তম্ভগুলো আন্দেশীয় পাথরের ছাঁচ দিয়ে তৈরি। ৫০ টন ওজনের এক একটি ছাঁচ প্রায় ৬ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ ছিল! তবে হাত্তুসার পাথুরে শিল্পের সবচেয়ে বড় রহস্যের উদ্ভব হয়েছে স্থাপনাগুলোর পাথরের বুকে তৈরি হওয়া অসংখ্য গোলাকার ছিদ্রকে কেন্দ্র করে। সামান্য কয়েকটি ছিদ্র নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাতামাতির প্রধান কারণ, এগুলো আকারে অত্যন্ত নিখুঁত এবং মসৃণ। বর্তমান যুগে ড্রিল মেশিনের সাহায্যে এই ধরনের ছিদ্র তৈরি করা সম্ভব। এর পূর্বে পেরুর কোরিকাঞ্চা মন্দিরে এরূপ অসংখ্য ছিদ্র আবিষ্কৃত হয়েছিলো।
এই নিদর্শন পর্যবেক্ষণের পর দুটো প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। প্রথমত, ঠিক কীভাবে হিট্টাইটরা এই ছিদ্র তৈরি করেছিলো? দ্বিতীয়ত, পাথরের বুকে রহস্যময় নকশায় তৈরিকৃত অসংখ্য ছিদ্রের আসল উদ্দেশ্য কী? গবেষকগণ এখন পর্যন্ত এই দুটো প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেন নি।
পৃথিবীর সর্বপ্রথম শান্তি চুক্তি
কূটনীতির জগতে হিট্টাইটরা এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে হিট্টাইটদের সাথে পরাক্রমশীল মিশর সাম্রাজ্য এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসের পাতায় এটি কাদেশ যুদ্ধ নামে পরিচিত। শক্তিশালী ফারাওরা এই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান স্বয়ং ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস। যুদ্ধ শেষে হিট্টাইটরা ফারাওকে অবাক করে এক অদ্ভুত প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হয়। সুদূরপ্রসারী হিট্টাইটরা যুদ্ধ থেকে স্থায়ী মুক্তি হিসেবে ফারাওয়ের সাথে তাদের রাজকন্যার বিয়ে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা প্রথম শান্তি চুক্তির মর্যাদা লাভ করেছে।
ফারাওদের সিলমোহর অঙ্কিত এই চুক্তিপত্রখানা বর্তমানে ইস্তাম্বুল প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। কাদেশ যুদ্ধ সন্ধিস্থাপনের ঘটনাটি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি লাভের পর এর একটি প্রতিলিপি নিউ ইয়র্কের জাদুঘরে প্রেরণ করা হয়।
ব্রোঞ্জ যুগে ইস্পাত বিপ্লব
তুরস্কের বুকে একখণ্ড সভ্যতার অধিকারী হিট্টাইটরা ধাতুশিল্পে অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল। এর প্রমাণ মেলে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহৃত যানবাহন এবং অস্ত্র-সরঞ্জামে ব্যবহৃত ধাতুর মাধ্যমে। হিট্টাইট কামারদের শৈল্পিক স্পর্শে গড়ে উঠতে থাকে যুগান্তকারী সব সরঞ্জাম। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন অস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ইতিহাসবিদগণ বেশ রোমাঞ্চকর সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে সাড়া জাগানো আবিষ্কার ছিল ইস্পাতের তৈরি রাজকীয় রথের ব্যবহার! এর ফলে যারপরনাই অবাক হয়েছেন গবেষকগণ।
কারণ হাত্তুসা নগরীর উদ্ধারকৃত ইস্পাতের সরঞ্জামগুলোর উৎপাদনের সময়ে পৃথিবীতে ব্রোঞ্জ যুগ বিরাজ করছিলো। পৃথিবীর প্রতাপশালী সাম্রাজ্যগুলো যুদ্ধেক্ষেত্রে ব্রোঞ্জের তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতো। কিন্তু হাত্তুসার সৈনিকরা ব্রোঞ্জের পাশাপাশি অধিক নমনীয় ইস্পাতের বিভিন্ন যানবাহন এবং অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। ফলে হিট্টাইটদের রথগুলো সমসাময়িক যেকোনো যানবাহনের তুলনায় দ্রুতগামী ছিল। এই তথ্য উদ্ঘাটনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধাতু ব্যবহারের ইতিহাস নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছেন।
সবুজ পাথরের ধাঁধা
রুক্ষ নগরী হাত্তুসার বুকে স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন নান্দনিক ভাস্কর্য এবং নিদর্শন। এদের গঠন এবং নির্মাণকালের সাথে ঐতিহাসিক তথ্যাবলীর অসামঞ্জস্যতার ফলে উত্থাপিত হয়েছে নানা প্রশ্ন। কিন্তু এতসব রহস্যের ভিড়ে বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে হাত্তুসার ধ্বংসাবশেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পাথর। যে কেউ প্রথম দেখাতেই পাথরগুলো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। গাঢ় সবুজ রঙের নানা গড়নের পাথরগুলো আবিষ্কার পর থেকেই গবেষকদের এক জটিল ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে।
প্রথমত, পাথরগুলোর পৃষ্ঠ সুনিপুণ কায়দায় মসৃণভাবে পালিশ করা। কথিত আছে, খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করলে নাকি পাথরের গায়ে ব্যক্তির প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে! তাই এই আশ্চর্য পাথর নিয়ে জ্ঞানপিপাসুদের প্রশ্নের অন্ত নেই। দ্বিতীয়ত, দর্শণার্থীদের অনেকেই দাবি করেছেন, এই পাথর স্পর্শ করলে দেহের ভেতর দিয়ে এক অদ্ভুত শক্তিপ্রবাহিত হয়। কিন্তু বিতর্কিত এবং অবৈজ্ঞানিক এই দাবি গবেষকগণ বহু আগেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরেও বিজ্ঞানীগণ এই পাথরের উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন নি। তবে ইতিহাসবিদগণ এই পাথরের উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব উত্থাপন করেছেন। পাথরগুলো হাত্তুসার কেন্দ্রীয় মন্দির থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। এর ফলে ধারণা করা হয়, এই পাথরগুলো হয়তো ধর্মীয় উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে অনেকেই ধারণা করেন, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস কাদেশ যুদ্ধ সন্ধিচুক্তির ফলে উপহারস্বরূপ হিট্টাইটদের এই পাথরগুলো প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এই তত্ত্বের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
এভাবে হিট্টাইটদের রহস্যঘেরা নগরী হাত্তুসা যুগের পর যুগ ধরে নানা প্রশ্ন নিয়ে আমাদের তাড়া করে ফিরছে। মাঝে মাঝে অবাক হতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীর রহস্য জট খুলতে কিনা একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে হার মানতে হচ্ছে! বিজ্ঞানীদের ধারণা, হাত্তুসার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা রহস্য সমাধা করতে হলে সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এই সভ্যতা আবিষ্কারের প্রায় ১০০ বছর পরেও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর সকল রহস্যজট খুলতে সক্ষম হবো। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।