ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ ইসলামের দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস হচ্ছে, আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর নিজ হাতে গড়া জাতিটির সদস্যরা এন্তেকাল করার পর ইবলিস এ জাতির আকিদায় বিকৃতি ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হল। যে লক্ষ্য নিয়ে রসুলাল্লাহ জাতিটি গঠন করেছিলেন অর্থাৎ সর্বাত্মক সংগ্রাম করে সমগ্র পৃথিবীতে বিরাজিত মানুষের তৈরি করা অন্যায়পূর্ণ ভারসাম্যহীন জীবনব্যবস্থাগুলোর বিলুপ্তি ঘটিয়ে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবনে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি এক কথায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, সেই লক্ষ্য জাতির সামনে থেকে হারিয়ে গেল।
প্রথমে লক্ষ্য হারালো জাতির শাসক শ্রেণি। ন্যায়পরায়ণ খেলাফতের যুগের সমাপ্তি হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল উমাইয়া রাজতন্ত্র। তারপর সেই রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করল আব্বাসীয় রাজতন্ত্র। খলিফারা হয়ে গেলেন সুলতান, তারা সমগ্র পৃথিবীতে সেই মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মতই শাসনাধীন ভূখণ্ডে শান-শওকত ও সীমাহীন ভোগবিলাসের সাথে রাজত্ব করতে লাগল। মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ড বহু রাজ্যে ও রাজতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে গেল যারা একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
ভোগবিলাসী সুলতান ও আমিরদের সকল অবৈধ কাজের অনুমোদন দেওয়ার জন্য সৃষ্টি হল দরবারি আলেম সমাজ। জাতি যখন দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করল তখন জাতির মধ্যে জন্ম নিল অতি-পণ্ডিত শ্রেণি যাদের কাজই ছিল দীনের গৌণ, অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক বিষয় নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অতি বিশ্লেষণ, চুলচেরা বিশ্লেষণ, সেগুলো নিয়ে তর্ক-বাহাস, মারামারি। এর পরিণামে শিয়া সুন্নিসহ শত শত মাজহাব, ফেরকা তরিকায় জাতি বিভক্ত হয়ে গেল।
এদিকে পারস্যের দিক থেকে জাতির মধ্যে প্রবেশ করল বিকৃত সুফিবাদ। জেহাদহীন জাতি এবার আধ্যাত্মিক সাধক, পীর-দরবেশদের তরিকায় দীক্ষিত হয়ে আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ করে রিপুজয় করাকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নিল। আত্মার ঘষামাজা করতে গিয়ে উম্মাহর বহির্মুখী চরিত্র বদলে অন্তর্মুখী হয়ে গেল। সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবীর প্রতি সকল দায়বদ্ধতাকে প্রত্যাখ্যান করে তারা নিভৃত নির্জন খানাকায়, মারকাজে গিয়ে ধ্যানে মগ্ন হল। তারা সুফি-দরবেশ হতে গিয়ে হারিয়ে ফেলল জাতির উদ্দেশ্য, হারিয়ে ফেলল রসুলাল্লাহর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধাচরিত্র। প্রচণ্ড গতিশীল বিস্ফোরণমুখী জাতি প্রাণহীন স্থবির হয়ে গেল।
এভাবে চললো কয়েক’শ বছর। ভেতরে বাহিরে শুরু হল পচনক্রিয়া। ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে, শরিয়তের ব্যাখ্যা নিয়ে মাজহাব ফেরকায়, শত শত আধ্যাত্মিক তরিকায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, দুর্বল হয়ে গেল। এরপর যখন ইউরোপের খ্রিষ্টান, মঙ্গোল ও তাতারদের আগ্রাসন শুরু হল তখন তা রুখবার মত প্রাণশক্তি, ঐক্য, শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে পুরো মুসলিম বিশ্বই একটা পর্যায়ে এসে ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টান শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে গেল। এই কয়েক শতাব্দী জুড়ে এই জাতির ইতিহাস কেবল নিজেরা নিজেরা হানাহানি করে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, বহিঃশত্রুর হাতে পরাজয়ের ইতিহাস, লাঞ্ছনার ইতিহাস, দাসত্বের ইতিহাস। সেই দাসত্ব এখন পর্যন্ত চলছে।