অপরাজেয় মুসলিম বাহিনীর স্বর্ণযুগের পতন ও সুফিবাদ উত্থানের ইতিকথা

0
1

ডা. শাহরিয়ার আহমেদঃ ইসলামের স্বর্ণযুগের পতন ও সুফিবাদের উত্থান। মুফাসসির ও পীর মুর্শিদদের কর্মকাণ্ডের পরিণাম

দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস হচ্ছে, আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর নিজ হাতে গড়া জাতিটির সদস্যরা এন্তেকাল করার পর ইবলিস এ জাতির আকিদায় বিকৃতি ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হল। সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার যে মহান লক্ষ্য নিয়ে রসুলাল্লাহ (সা.) জাতিটি গঠন করেছিলেন সেই লক্ষ্যটি জাতির সামনে থেকে হারিয়ে গেল।
.
প্রথমে লক্ষ্য হারালো জাতির শাসক শ্রেণি। ন্যায়পরায়ণ খেলাফতের যুগের সমাপ্তি হতে না হতেই শুরু হল উমাইয়া রাজতন্ত্র। সেই রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করল আব্বাসীয় রাজতন্ত্র। খলিফারা হয়ে গেলেন সুলতান। তারা সমগ্র পৃথিবীতে সেই মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মতই শান-শওকত ও সীমাহীন ভোগবিলাসে ডুবে গেলেন। অর্ধ-পৃথিবী বিস্তৃত মুসলিম ভূখণ্ড বহু রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
.
ভোগবিলাসী সুলতান ও আমিরদের সকল অবৈধ কাজের অনুমোদন দেওয়ার জন্য সৃষ্টি হল দরবারি আলেম সমাজ। আরও জন্ম নিল অতি-পণ্ডিত শ্রেণি। জাতি যখন সংগ্রাম ত্যাগ করল তখন তাদের হাতে অফুরন্ত সময় এবং পায়ের নিচে বিপুল সম্পদরাশি। কর্মব্যস্ততাহীন জাতির সেই অতি পণ্ডিত অংশটি খুঁজে নিল সময় অতিবাহিত করার এক জাতিবিনাশী পথ। সেটি হচ্ছে দীনের গৌণ, অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক বিষয় নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা, অতি বিশ্লেষণ, চুলচেরা বিশ্লেষণ, তর্ক-বাহাস, মারামারি। তাদের এই দীন নিয়ে বাড়াবাড়ির পরিণামে জাতি শিয়া সুন্নিসহ শত শত মাজহাব, ফেরকা তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল।
.
এরই মধ্যে পারস্যের দিক থেকে জাতির মধ্যে প্রবেশ করল বিকৃত ভারসাম্যহীন সুফিবাদ। এখানে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যেখানে শরিয়তের বিধি-বিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি আত্মার পরিশুদ্ধি (তাকওয়া) অর্জনের ব্যবস্থাও রয়েছে। এক কথায় ইসলাম শরিয়ত ও মারেফতের সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান।
.
কিন্তু জাতীয় জীবনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ যখন উম্মাহ ত্যাগ করল তখন তাদের বড় একটি অংশ সম্পূর্ণরূপে সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ফলে দীনের ভারসাম্য হারিয়ে গেল। সময়ের পরিক্রমায় বহু ধরনের সুফিবাদী তরিকার বিস্তার ঘটল। যে উম্মতে মোহাম্মদীর জীবনের লক্ষ্য ছিল প্রাণ-সম্পদ উৎসর্গ করে বিরতিহীন সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর তাবৎ অত্যাচারীর অত্যাচার বন্ধ করা, পরবর্তীতে সেই উম্মতে মোহাম্মদী নামধারীরা শত শত তরিকায় বিভক্ত পীর-দরবেশদের বায়াত নিয়ে আত্মার ঘষামাজা করে হয়ে গেল দুনিয়া সম্পর্কে উদাসীন, বৈরাগ্যবাদী, অন্তর্মুখী, স্থবির। তারা সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবীর প্রতি সকল দায়বদ্ধতাকে ছুঁড়ে ফেলে নিভৃত নির্জন খানাকায়, মারকাজে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হল; ভুলে গেল জাতি গঠনের উদ্দেশ্য, হারিয়ে ফেলল দিগ্বিজয়ী যোদ্ধাচরিত্র। প্রচণ্ড গতিশীল বিস্ফোরণমুখী জাতি গতি হারিয়ে প্রাণহীন স্থবির হয়ে গেল।
.
সেই একপেশে ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফিবাদ বর্তমানে পীর-মুরিদি ব্যবসায় পর্যবসিত হয়েছে। যাহোক, এভাবে ভেতরে বাহিরে পচনক্রিয়া চলল কয়েকশ বছর। ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি সিংহাসনের দ্বন্দ্বে, শরিয়তের ব্যাখ্যা নিয়ে মাজহাব ফেরকায়, শত শত আধ্যাত্মিক তরিকায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এরই মধ্যে যখন ইউরোপের খ্রিষ্টান, মোঙ্গল ও তাতারদের নির্দয় নিষ্ঠুর আক্রমণ শুরু হল তখন তা রুখবার মত চেতনা, ঐক্য, শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব বা সাহস কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। পুরো মুসলিম বিশ্বই একটা পর্যায়ে ইউরোপের ছোট ছোট খ্রিষ্টান জাতির কাছে পরাজিত হয়ে গেল। এই কয়েক শতাব্দি জুড়ে এ জাতির ইতিহাস ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, বহিঃশত্রুর হাতে পরাজয়, লাঞ্ছনা ও দাসত্বের ইতিহাস। সেই দাসত্ব এখন পর্যন্ত চলছে।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here