আব্দুল আলীম, চৌগাছা প্রতিনিধিঃ কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকাল। গ্রামের মাঠে-ঘাটে তখনও সূর্যের আলোর দেখা না মিললেও গাছিরা বেরিয়ে পড়েন খেজুর রস আহরণে। সারিবদ্ধ খেজুর গাছে উঠে রস ভর্তি হাঁড়ি (ছোট কলস) নামিয়ে আনেন। এভাবে কয়েকটি গাছের রস এক সঙ্গে করে আট থেকে ১০ হাঁড়ি পূর্ণ করে ঘাঁড়ে বাঁক বাঁধিয়ে গাছি রওনা হন বাড়িতে। গাছি বধূরা ওই রস ছেঁকে (ময়লা পরিষ্কারের জন্য) মাটির চুলায় তাফালে (অ্যালুমিনিয়ামের বিশেষ পাত্র। যাতে রস জ্বাল দেওয়া হয়) জ্বালিয়ে তৈরি করছেন সুস্বাদু নলেন গুড়।
যশোরের মানুষ এই খেঁজুর রস ও নলেন গুড়ের গন্ধে মাতোয়ারা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও যশোর জেলার গাছিরা শীতের শুরুতেই খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য গাছ তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে । কিন্তু বর্তমানে এই খেজুর চাষীর সংখ্যা খুবই কম । প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য যশোর জেলার খেজুর গাছের। যশোর এক সময় খেজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিলো। শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে খেজুর গাছ (তোলা) কাটার প্রতিযোগিতা পড়েছে গাছিদের মধ্যে। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক এ অঞ্চলের খেজুর গাছ। অনেকে এটা শখের বসে বলে থাকেন মধুবৃক্ষ। গত কয়েক বছর ইট ভাটার জ্বালানি হওয়ায় দ্রুত খেজুর গাছ ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। যশোরে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বন বিভাগের উদ্যোগে ২০০৯ সালে বেশ কিছু খেজুর গাছ রোপন করা হয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বৃহত্তর যশোর জেলার জীববৈচিত্রের সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গত কয়েক বছরে রোপিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ খেঁজুর গাছের চারা। দেশী জাতের সাথে পরীক্ষামূলক ভাবে আরব দেশীয় খেঁজুরের চারাও রোপিত হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অতীতে কখনও খেঁজুরের চারা রোপন করা হয়নি। যশোরের আবহাওয়ার সাথে মানানসই খেঁজুর গাছ এমনিতেই জন্মে। বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় খেজুরের বাগান। এখন শীতকাল তাই অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা খেজুর গাছের কদর বেড়ে উঠেছে। কারণ এ গাছ এখন দিবে গাঢ় মিষ্টি রস। আর এরস জ্বালিয়ে পাতলা- ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালি তৈরী করা হয়। খেজুরের গুড় থেকে এক সময় বাদামী চিনিও তৈরী করা হতো। যার সাধ ও ঘ্রান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাদের তৃপ্তিতে বাদামী চিনির জুড়ি নেই। এখন অবশ্যই সেই চিনির কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রুপ কথার গল্পের মত মনে হয়। খেজুর গাছের বৈশিষ্ট হচ্ছে যত বেশী শীত পড়বে তত বেশী মিষ্টি রস দেবে। পুরোপুরি মৌসুমে চলবে রস, গুড়, পিঠা-পুলি, পায়েস খাওয়ার পালা। আর কিছুদিন পর নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধে ধীরে ধীরে আমোদিত হয়ে উঠবে গ্রাম বাংলা। দিন শেষে গ্রামীন সন্ধ্যা কালিন পরিবেশটা বড়ই আনন্দের। খেঁজুর রসের কারণে গ্রামীণ পরিবেশটা মধুর হয়ে উঠে। মন ভরে যায় সন্ধ্যার খেঁজুরের রসে। এখন সবে মাত্র শুরু হয়েছে রস সংগ্রহের জন্য গাছ তোলা ও চাঁচ দেবার পালা। আর কিছুদিন পর পুরোদমে শুরু হবে খেজুর গাছের রস খাওয়ার ধুম। শহর থেকে দলে দলে ছুটে আসবে গ্রামে। এই সময় খেজুর গাছ থেকে রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণ চাঞ্চল্য বাড়বে। যদিও আগের মত সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে কম বেশী খেঁজুর গাছ এখনও রয়েছে। তবে যশোর জেলার ঐতিহ্য থাকার কারণে বলা হয়ে থাকে যশোরের যশ খেঁজুরের রস। যশোর অঞ্চলে এক সময় গড়ে উঠেছিল খেঁজুর গুড়ের চিনি উৎপাদনের কারখানা। যা শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ কালের বিবর্তনে এখন খেঁজুরের গুড়ের কথা অনেকের মনে নেই। এখন শিল্পও আর নেই, নেই চিনি উৎপাদনের কারখানাও। কোন রকম চলছে খেঁজুর গাছ থেকে রস আরোহন করে গুড়, পাটালী তৈরী ও পিঠা পায়েস খাওয়ার কাজ। তাও চাহিদার তুলনায় একবারে কম। অথচ পরিকল্পিত ভাবে খেঁজুরগাছ লাগানো হলে শুধু মৌসুমের উপদায়ী রস গুড় নই, দেশীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভুামিকা রাখতে পারবে। সরকারকে এ ব্যাপারে বহুবার দৃষ্টি আকর্ষন করার পর এবার বন বিভাগ উদ্যেগ নিয়েছে খেঁজুর গাছ লাগানোর এবং গবেষনা করা হচ্ছে কিভাবে অর্থকারী করে তোলা যায়। এদিকে এই শিল্পর সরকারী পৃষ্টপোষকতার ব্যবস্থা না থাকায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর ইটভাটা ও টালি তৈরির কারখানায় প্রচুর পরিমানে খেজুর গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের চৌগাছা থেকে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর যাবার রাস্তা ধরে ১০ কিলোমিটার এগুলে সামনে পড়বে হাকিমপুর বাজার। বাজারের পশ্চিম পার্শে ২/৩ কিলোমিটার পশ্চিমে তাহেরপুর বাজার। এখানে এক সময় খেঁজুরের গুড় থেকে চিনি উৎপাদনের বিশাল কারখানা গড়ে উঠেছিলো। বর্তমানে কারখানাটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মাটি দিয়ে ঢাকা রয়েছে। এখন এটা কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের এক নাগরিক তাহেরপুরে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চিনি উৎপাদন করেছিলেন বলে জানা যায়। খেজুরের রস ও গুড় ঐ কারখানার কাঁচা মাল হিসাবে ব্যবহার হত। প্রায় এক টানা ২০ বছর চালু থাকার পর বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৮৪ সালে পুনরায় কারখানাটি চালু করেন এ্যামেট এন্ড চেম্বার কোম্পানি। ১৯১০ সাল পর্যন্ত চলে খেঁজুর গুড়ের চিনি উৎপাদন কারখানাটি। ওই সময় কালে চিনির জন্য দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন বণিক দল ছুটে আসতো তাহেরপুরে। বড় বড় জাহাজও ভিড়তো খেজুরের চিনির সন্ধানে।
কথা হয় চৌগাছার হাকিমপুর ইউনিয়নের তাহের পুরের মৃত কাটু মল্লিকের ছেলে মোশারফ মল্লিকের সাথে। তিনি বলেন তার ৪৫-৫০ টি খেজুর গাছ আছে। তিনি নিজেই এই গাছ তোলা থেকে শুরু করে চাঁচ দেওয়া, গাছ কাটা, রস বাড়িতে নিয়ে আসা, গুড় তৈরী পর্যন্ত সব কাজ নিজে হাতে করেন। তবে গুড় তৈরিতে তার স্ত্রী সাহায্য করেন। তিনি আরও বলেন বর্তমানে গাছ তোলা, কাটা, রস পাড়ার লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খেজুরের গাছ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কেউ আর এসব ক্ষেত্রে কষ্ট করতে চায় না। আধুনিক ডিজিটাল যুগে মানুষ অন্যান্য পন্থায় বেশি বেশি ইনকাম করতে পারায় এসব কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। তবে তিনি বলেন আমি এখনো গাছ কাটি এবং গুড় তৈরি করি। আমার খাওয়ার চাহিদা মিটিয়ে গুড় এবং রস বিক্রি করে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা আয় করি। প্রত্যেক বছর ঢাকায় বসবাসরত কয়েকজন কে গুড় পাঠাতে হয়। সেক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট টাকা আয় হিসেবে আসে। তিনি আরও বলেন খেজুরের পাতা দিয়ে তৈরী হয় সিতল পাটি। কোন পরিচর্যা ছাড়া খেঁজুরের গাছ বিভিন্ন স্থানে ঝোপ আকৃতিতে বড় হয়ে উঠে। জমির আইলে, বাগানের পতিত জমিতে ও বাড়ির আঙ্গিনায় খেঁজুর গাছ বেশী জন্মে। ৫ বছর পর একটি গাছ রস দেবার উপযোগী হয়। ১৫/২০ বছর পর্যন্ত ভালোভাবে গাছ থেকে রস পাওয়া যায়। খেজুর গাছ বছরের ৪ মাস রস দেয়। ১০/১২ টি খেঁজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে ১টি পরিবার অনায়াসে সংসার ব্যয় চালাতে সক্ষম হয়।
অপর একজন গাছি উপজেলার সদর ইউনিয়নের দক্ষিন কয়ারপাড়া গ্রামের তারিক গাজী জিবনের বহু বছর তিনি এ পেশায় নিয়োজিত আছেন। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন একজন গাছি প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ১৫-২০টি গাছ তুলতে পারেন। বর্তমানে গাছ তোলা ও কাটার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আমি এখনো শীতের সময় এই কাজে ব্যস্ত থাকি। আমার খুব ভালো লাগে। তিনি আরও বলেন ইতি মধ্যে উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার কম বেশি প্রায় সব জায়গায়ই খেজুর গাছ তোলা শেষ হয়েছে। দুই এক দিনের মধ্যেই খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে রস। নতুন রস ও গুড়ের জন্য বাড়ি বাড়ি লোকের ভিড় দেখা যাবে।