আজিজুল হক নাজমুল –
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
লটারির মাধ্যমে কৃষকদের তালিকা করে পর্যায়ক্রমে তাদের কাছ থেকে ধান কেনার কথা থাকলেও কুড়িগ্রামে নির্বাচিত কৃষকদের তালিকাতে স্থান পেয়েছে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও ভাই এবং ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের তিন সদস্যসহ ১১ ইউপি সদস্যের নাম। ঘটনাটি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে ধান উৎপাদনকারী নির্বাচিত কৃষকদের তালিকা থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন হলোখানা ইউনিয়নের কৃষি কার্ড না পাওয়া এক ইউপি সদস্য। তবে লটারি নয়, সুপারিশের মাধ্যমে নাম অন্তর্ভুক্তির কথা স্বীকার করেছেন হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: উমর ফারুক।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধান উৎপাদনকারী নির্বাচিত কৃষকদের তালিকা এবং ওই ইউপি সদস্যের দেওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ধান ক্রয়ের জন্য নির্বাচিত কৃষকদের তালিকায় হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান উমর ফারুক, তার স্ত্রী স্মৃতি ফারুক, ছেলে রাজ্জাক রাজু ও রেজাউল করিম, ভাই (মৃত) হোসেন আলীর নাম রয়েছে। এছাড়াও হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৮ জন ইউপি সদস্য এবং ৩ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত কৃষকদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
হলোখানা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মো: খাইরুল ইসলাম জানান, ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের তালিকা প্রণয়নে হলোখানা ইউনিয়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে। তিনি বলেন, লটারির নামে প্রহসনের মাধ্যমে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত করার পাশাপাশি প্রকৃত কৃষকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচনের নিয়ম থাকলেও হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ও তার পরিবারের লোকজনসহ ইউনিয়ন পরিষদের সব সদস্য কীভাবে নির্বাচিত তালিকায় স্থান পেলেন তা নিয়ে এলাকার কৃষকদের মাঝে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বঞ্চিত কৃষকরা বলছেন, এটা লটারির নামে প্রহসন করা হয়েছে। আর এতে ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুকসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বে থাকা কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে।
এলাকার কৃষকদের অভিযোগ, কোনও ধরনের প্রচারণা ছাড়াই ইউনিয়ন পরিষদে প্রহসনের লটারি করা হয়েছে যা এলাকার সব কৃষক জানতেন না।
উক্ত ইউনিয়নের বড়াইবাড়ী গ্রামের শাহীন বলেন, প্রতি মৌসুমে আমাদের প্রায় দেড় থেকে দুইশ’ মণ ধান উৎপাদন হয়। আমার বাবার কৃষি কার্ডও রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হলেও আমরা তা জানতে পারিনি। এলাকায় কোনও ধরনের প্রচারণা ছাড়াই লটারির নামে প্রকৃত কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করে কৌশলে চেয়ারম্যান ও তার অনুসারীদের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।
ওই এলাকার কৃষি কার্ডধারী স্কুল শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘কৃষক নির্বাচনে লটারির কোনও খবর আমরা পাইনি। পরে লটারি হওয়ার পর শুনি, চেয়ারম্যানের পরিবারসহ পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত কৃষকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন। জনপ্রতিনিধি হয়ে তারা এলাকার কৃষকদের প্রতারণা করেছেন। এই লটারি আবারও জনসম্মুখে হওয়া উচিত।’
বিষয়টি স্বীকার করে হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: উমর ফারুক বলেন, ‘আমি বলেছিলাম যে আমার অনেক আবাদ আছে, সেজন্য আমার পরিবারের চারটি নামসহ পরিষদের ১২ জনের নাম দিতে। এটা নিয়ে যেহেতু কথা উঠেছে সেহেতু সংশোধন করে নেবো।’ লটারি করার পরও কীভাবে আপনাদের সবার নাম আসলো, এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, মাত্র ১২/১৪ টা নাম খুব বেশি নয়!’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ি, কুড়িগ্রামের উপ-পরিচালক ড. মো: মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু অভিযোগ ইউএনও বরাবর গিয়েছে এবং ইউনিয়ন পরিষদ তার অধীন সেহেতু কৃষকের তালিকায় গড়মিল নিয়ে তিনি দেখবেন।’
তবে নির্বাচিত কৃষকদের তালিকা তৈরিতে উন্মুক্ত লটারি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুস ছালাম। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে উপস্থিত থেকে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করেছি। তখন কেউ কোনও আপত্তি করেননি।’
উন্মুক্ত লটারি হলে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পরিবারের ৫ জন সদস্যসহ উক্ত ইউনিয়ন পরিষদের সব জনপ্রতিনিধি কীভাবে তালিকায় স্থান পেলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এই খাদ্য কর্মকর্তা বলেন,‘ আমি তালিকাটি আবারও দেখবো। এক্ষেত্রে কোনও অসংগতি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নির্বাচিত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত ও লটারির প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, ‘আমি এখনও অভিযোগটি হাতে পাইনি। অভিযোগের বিষয়টি দেখে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।