মিতুল হোসেন – দেশকে ভালবাসতে কোনো বয়স লাগেনা আর দেশকে ভালবাসতে টাকাও লাগেনা”। দরকার শুধু মন থেকে একটিবার চিন্তা করা যে এই দেশটা আমার নিজের মায়ের সমান। অন্তর থেকে যেদিন এই বিষয়গুলা ধারণ করতে পারবো সেদিন কিন্তু আমাদের সত্যিগুলো হবে এই কোটি কোটি মানুষের প্রত্যেকেটা হৃদয়ের একটা শক্তি। কিন্তু সেইভাবে অনুভব করতে হবে যে আসলেই আমি দেশকে ভালোবাসি তাহলে কোনো উদ্যোগ নিতে আর পিছপা হওয়ার কোনো জায়গা থাকেনা। নিউজ নাইটিন এর বিশেষ সাক্ষাৎকারে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন এলজিএসপির স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব তরুন লেখক মনদীপ ঘরাই।
নিউজ নাইটিনের বিশেষ এ সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো নিউজ নাইটিনের সকল পাঠকদের জন্য:
নিউজ নাইটিন : কেমন আছেন আপনি?
মনদীপ ঘরাই : সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে ভালো আছি । সৃষ্টিকর্তা যা দিয়েছেন আমার প্রত্যাশা বলি যোগ্যতা বলি তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন। বেশি দিয়েছেন এই কারণে আমরা চাইলেও কিন্তু কোনোদিন কিছু করতে পারবো না যদি সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে না দেন।
নিউজ নাইটিন : সরকারী কর্মকর্তা হয়ে আপনার জনসেবামূলক কাজগুলো করার পেছনের অনুপ্রেরণা জানতে চাই?
মনদীপ ঘরাই : অবশ্যই অনুপ্রেরণা আছে। অনুপ্রেরণার জায়গাটা আসলে কাজ করতে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি। আমরা যতই বলি যে জনগনের সেবক বা জনগনের সেবা করার জন্য আমাদের চাকরি। যদি সত্যিকার অর্থে সেটা করতে যাই তখন বোঝা যায় যে মানুষের আস্থাটা কত বেশি এবং আস্থা রক্ষার তাগিদ থেকেই কিন্তু মূলত কাজ শুরু করা। অভয় নগরে যখন ভারপ্রাপ্ত ইউএনও ছিলাম সেখান থেকেই মানুষের কাছে আসা শুরু। যখন আমরা ছাত্র অবস্থায় থাকি একটা ছাত্রের উপরে মানুষ যে বিশ্বাস করবে ভরসা করবে সেরকম চেনা জানার গন্ডিটা কিন্তু বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বন্ধুদের মধ্যে কতটা বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছি সেটা আমার বন্ধুরা বলতে পারবে। পরিবার আমার উপর আস্বস্ত হচ্ছে যে আমার ছেলে ভালো পথেই যাচ্ছে। কিন্তু যখন চাকরী করতে আসলাম দেখলাম যে আর পাঁচটা মানুষের কাছে যে কয়জন মানুষ যাচ্ছে আমার কাছে বেশি আসে এটা নিয়ে অহংকারের চাইতে আমি যদি এটাকে সুযোগ হিসেবে নেই সেই সুযোগটা কাজে লাগানোর সবচেয়ে মক্ষম জায়গা হলো পদের যথাযথ ব্যবহার করা, আমি সেইটাই শুধু চিন্তা করেছি যে আমার জায়গা থেকে যতটুকু করা যায়। পরে যেটা দাাঁড়ালো একটা দুইটা কাজ করতে করতে মনের মধ্যেই একটা তাগিদ তৈরি হয়েছে যে আসলে নিজে,নিজের পরিবার এবং চারদিকের মানুষজনের বাইরে আমি কী একজন মানুষ না! আর যদি মানুষ হয়ে থাকি, তাহলে আমার চেয়ে যারা একটু খারাপ আছে তাদের প্রতি একটা দায়িত্ব থেকে যায়। আসলে এ দায়িত্ববোধ থেকেই আমার এই কাজে এগিয়ে আসা।
নিউজ নাইটিন : আপনি অভয়নগরে থাকাকালীন শান্তিলতা দেবীকে সহযোগিতা করেছিলেন এ বিষয়ে জানতে চাই?
মনদীপ ঘরাই : অভয় নগরে যাওয়ার পরে তরুণ প্রজন্ম আসলে আইডেন্টিফাই করা শুরু করল নিজেদেরকে যে আমার মত একজন মানুষ এসেছে যে কিনা আমাদরে মতই ফেইসবুক চালায় আমাদের মতই হাসে এবং আমাদের প্রোগ্রামগুলোতে আসে। আমি সকল প্রোগ্রামে যেতাম সেটা হোক ছোট বা বড়। যওয়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে ওরা যাতে বুঝতে পারে যে এই মানুষটা আমাদের সাথে আছে। তাতে করে যেটা হলো যে অভয়নগরে আমার অফিসিয়াল আইডিতে সবাই এ্যাড হয়ে গেল তরুণ প্রজন্ম যারা আছে। এখন যেটা হতো উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোথায় কী হচ্ছে সেটা আমি ইনবক্সে পেয়ে যেতাম। একদিন রাত তিনটার সময় একটা ম্যাসেজ পাই একজন লিখেছে স্যার আপনার একটু সাহায্য দরকার, শান্তিলতা দেবীর ঘর ভেঙ্গে তাকে রাস্তায় বের করে দিয়েছে এবং সাপের একটা গুজব উঠছে যে তার বাসায় সাপ পাওয়া গেছে সে এখন রাস্তায়। আমি ওকে শুধু লিখলাম যে এত রাতের বেলায় তো যাওয়া সম্ভব না আমি সকাল বেলায় যাব। পরেরদিন সকালে উঠেই সেই জায়গায় যেয়ে শান্তিলতা দেবীকে উদ্ধার করেছি এবং তাকে একটা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সাথে সাাথেই করা হয়েছে। আমি কথা দিয়ে এসেছিলাম যে তাকে একমাসের মধ্যে একটা শান্তিনীড় গড়ে দেব এবং এলাকার সকলের সহযোগিতায় একমাসের মধ্যেই তাকে আমরা বাড়ির চাবি হস্তান্তর করেছি। ভাললাগার বিষয় হলো আজকে ঠিক দুবছরের মাথায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সেদিন শান্তিলতা দেবীকে সম্মাননা দিয়েছেন। এটা বিশাল বড় পাওয়া আমার জন্য।
নিউজ নাইটিন : গত কয়েক বছরে ধরে আপনি পহেলা বৈশাখে সরকারী ভাতা উৎসর্গ করছেন এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
মনদীপ ঘরাই : এটা একটা ধারণা বলতে পারেন। ধারণা বলব একারণে যে আমরা আগে পহেলা বৈশাখে ভাতা পেতাম না , মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন এবং অবশ্যই শুভ উদ্যোগ কিন্তু আমার একটা জিনিস চিন্তা হলো যে যদি আগে ভাতা ছাড়া নববর্ষ কাটানো যায় তাহলে সেই ভাতা ছাড়া আমি এবারের নববর্ষ কাটাতে পারবো। তাহলে সেই ভাতাটা দিয়ে যদি আমি দুইটা মানুষ হোক আর একটা মানুষ হোক তাদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারলে এটা কাজে লাগবে। গত বছর যখন রাজীব দূর্ঘটনায় পড়ল তার হাত কাটা পড়েছে এবং পরে আর বাঁচানো যায়নি। গত বছরের ভাতাট আমি রাজিবের জন্য উৎসর্গ করেছিলাম। এবছর যখন ভাতার সময়টা আসল আসল আমি আমার সহধর্মিণী কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমরা কী করব? মজার ব্যাপার হলো যে সেই আমাকে বলল যে আমরাতো ভাতার টাকাট খরচ করিনা তো আমাদের দরকার নেই তুমি তোমার মত করে কাজে লাগাও। তারপরে স্বদেশ মৃত্তিকা ফাউন্ডেশনে ডাক পাই এবং আমি আগে থেকে কিছু বলিনি ওখানে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছি যে এই বাচ্চাদের জন্য নববর্ষের ভাতা পুরোটাই আমি দিয়ে দিব এবং দিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে এই হাসিগুলো আমরা সেদিন দেখেছি বা ওদের যে আনন্দটা, ওরা কিন্তু কেউ আমাকে ওদের বাইরের কেউ মনে করেনি।এইটা আমার বড় পাওয়া।
নিউজ নাইটিন : নতুন লেখক হিসেবে আপনি আপনার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন ব্যতিক্রম উদ্যোগের মাধ্যমে এই বিষয়ে সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
মনদীপ ঘরাই : যখন লেখকদের কোনো বই বের হয় প্রত্যেককের একটা চিন্তা থাকে যে তাদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে এবং তাই সবাই করে। আমি যখন বইটা লেখা শুরু করলাম তখন আমার চিন্তা হয়েছে যে লেখাতো আমার পেশা না, তাহলে এখান থেকে কী আমি লাভ চাচ্ছি কি না বা এখান থেকে আমার আর্থিক সংশ্লেষ হওয়া উচিত কী না? মন থেকেই এই তাগিদটা অনুভব করেছি যে এখান থেকে আমার টাকার প্রয়োজন নেই, আর যদি দরকার না হয়ে থাকে তাহলে বইয়ের যদি এক পয়সাও লাভ হয় সেটা কার জন্য যাবে ? তখন চিন্তা আসছে যে আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আমি একটু ভিন্ন ভাবে করলে দোষ কোথায়? আমরা তিনজন পথ শিশুকে ডাকলাম, সবচেয়ে মজার বেপার হলো যে ওরা ওইদিন অতিথি হিসেবে প্রথম দিকে মেলাতে পারেনি পরে অনেক আনন্দ করেছে। আমরা এক টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করেছি গল্প করেছি এবং ওই দিনই ঘোষণা দিয়েছি যে লাভের একুশ শতাংশ ওদের জন্য দেব কিন্তু পরবর্তীতে যেটা হয়েছে মন আরও ঘুরে গেল যে একুশ শতাংশ দিয়ে কী হবে পুরোটাই দিয়ে দেই। এখন পর্যন্ত সেটাই ঠিক আছে ক্যাম্পাসের মেলাগুলো চলছে মেলাগুলো শেষ হলে বইয়ের যে লভ্যাংশ পুরোটাাই ওই তিনজনের জন্য আমি দিব। আজকে নিউজ নাইটিনকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমি জানিনা আমি ভাল লেখি কী খারাপ লেখি! সামনে হয়ত আরও বই বের করব। যত বই যতদিনই বের করব এর থেকে একটা অংশ অবশ্যই পথশিশুদের জন্য ধরা থাকবে।
নিউজ নাইনটি : আপনার লেখা বা সাহিত্য বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই?
মনদীপ ঘরাই : আমার লেখার গন্ডিটা সত্যি কথা বলতে যেটা আমরা যেহেতু সিনেমা দেখি কোনো ভাবে বলা যায় যে ম্যাজিক রিয়েলিজম কাজ করে যেটা বাস্তবিক জীবনের সাথে মেলানো যায় না।ওইগুলা দেখতে লোকজন পছন্দ করে আমার গল্পে আমি যেটা করেছি যে, আমরা যেভাবে জীবন টাকে দেখি সেভাবেই লিখি আপনি দেখবেন যে আমি গ্রাম নিয়ে লেখি কম কারন গ্রামীণ জীবন আমার দেখা হয়েছে কম। বর্তমানে যেই জায়গাটায় আছি সে জায়গাটা নিয়ে লিখছি। মানুষ নগরের মধ্যে গল্পের খুব অভাববোধ করে কিন্তু আসলে এই নগরের শতশত গল্প প্রতিদিন হচ্ছে। আমার মনে চায় যে আমি আমার জীবনে দেখা সবকিছু কাগজে তুলে ধরতে পারতাম অন্তত একটা প্রোটোটাইপতো তৈরি হতো সেখানে সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকতো,যে একটা মানুষ কী খী দেখছে। আমি দেখার মাধ্যমেই গল্প বের হয়ে আসে,গল্পগুলো অন্যকোনো জগৎ থেকে উড়ে আসেনা । তবে পথশিশুদের নিয়ে আমার লেখা আমার ‘অল্পগল্প’ নামে একটা বই রয়েছে।
নিউজ নাইটিন : আপনার সকল কার্যক্রমের পিছনের অনুপ্রেরণাকারীদের সম্পর্কে জানতে চাই?
মনদীপ ঘরাই : সত্যি কথা বলতে কী অনুপ্রেরণার জয়গাটা আসলে আমার বাবা-মা এবং পরিবার কিন্তু সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি যে আামদের পরিবারের সকলের মধ্যে মানবতার যে বিষয়টা সবার মধ্যে সেটা পরিষ্কার, আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন তাই দেশকে ভালবাসাটা বাবার কাছেই শেখা। মায়ের কাছে দেখেছি গ্রাম থেকে যখন মানুষ বিভিন্ন সাহয্যের জন্য এসে সাতদিন আটদিন থেকেছে কখনও মায়ের মুখের হাসি ম্লান হতে দেখেনি এরপর কর্মক্ষেত্রে আসলাম তারপর বিয়ে করেছি। আমার সহধর্মিণী আমার অনুপ্রেরণার বড় একটি জায়গা। আমি যতগুলো কাজ করেছি এবং করি তার পেছনে সবসময় তাঁর একটা অদৃশ্য হ্যাঁ সবসময় থাকে। কখনও বলেনি যে এটা করছ কেন? বরং আরও উৎসাহ প্রদান করে বলে যে, অনেকেই পারে না তুমি পারছো এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
নিউজ নাইটিন : আপনার মত বা আপনার থেকে বড় ছোট সকল অবস্থান থেকে মানুষের সেবা করার বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
মনদীপ ঘরাই : একটা বিষয় হলো “দেশকে ভালবাসতে কোনো বয়স লাগেনা আর দেশকে ভালবাসতে টাকাও লাগেনা”। দরকার শুধু মন থেকে একটাবার চিন্তা করা যে এই দেশটা আমার নিজের মায়ের সমান। অন্তর থেকে যেদিন এই বিষয়গুলা ধারণ করতে পারবো সেদিন কিন্তু আমাদের সত্যিগুলো হবে এই কোটি কোটি মানুষের প্রত্যেকেটা হৃদয়ের একটা শক্তি। কিন্তু সেইভাবে অনুভব করতে হবে যে আসলেই আমি দেশকে ভালোবাসি তাহলে কোনো উদ্যোগ নিতে আর পিছপা হওয়ার কোনো জায়গা থাকেনা।
নিউজ নাইটিন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
মনদীপ ঘরাই : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা চিন্তা বলতে তিন ধরণের কাজ করে একটা হলো নিজস্ব জীবনে আমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাই? হ্যাঁ পার্সোনাল লাইফে আমি সফল একজন সন্তান হতে চাই, সফল স্বামী এবং পরবর্তীতে সফল একজন পিতা হতে চাই। কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের ইচ্ছা আমার অবশ্যই আছে আর মানবতার ক্ষেত্রে যদি বলি এটা কোনো লক্ষ্য নিয়ে আমি আসলে আজ পর্যন্ত করিনি এবং আগামিতেও করবনা। আমার সামনে যা আসবে যতটুকু দেখব মানুষের জন্য যতটুকু করতে পারব আমার মনে হয় এটা স্বয়ংক্রিয় ভাবে এবং মন থেকে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে হওয়া উচিত এবং সে ভাবেই করে যেতে চাই।
Courtesy — নিউজ নাইনটিন