জহর হাসান সাগরঃ
সব হারিয়ে ৪১ বছর ধরে খুব কষ্ট জীবন যাপন করছে আনোয়ারা ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনের সব কিছু হরিয়ে বস্তির কুড়েঘরে অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জলিল শাহ এর নিঃসন্তান স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর দেয়া কৃতজ্ঞতা পত্র আর দুই হাজার টাকা ছাড়া বিজয়ের এত বছরেও মেলেনি সরকারী বেসরকারী কোন সহায়তা। রাজশাহী নগরীর তালাইমারি এলাকায় বাদুরতলা বদ্ধভুমির পাশে জরাজীর্ণ ঝুপড়ি ঘরে অনাহারে অর্ধাহারে কেটে গেছে তার ৪১ বছর। বৃদ্ধ বয়সেও দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য অন্যের দুয়ারে দুয়ারে ছুটে বেড়াতে হয় প্রতিনিয়ত।
রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের ধারেই ভাঙ্গাচোরা ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরেই বসবাস বৃদ্ধ আনোয়ারা বেগমের। সহায় সম্বল বলতে নড়বরে ঘুনেধরা একটা চৌকি,থালাবাটি আর একটা বাক্স। প্রতিবেশির দয়ায় বেঁচে থাকা ৭৭ বছর বয়সী এই মানুষটি আজ বড় অসহায়। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল আনোয়ারা বেগমের। সে সময় সব কিছুই ছিল তার। স্বামী ব্যবসা করতেন। নগরীর তালাইমারি বাদুর তলা এলাকাতেই ছিল তার দোতালাবাড়ি। বাড়িটি এখনও টিকে থাকলেও তাতে বসবাস অন্যের।
বৃদ্ধ আনোয়ারা জানান, যুদ্ধকালীন সময়ে স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যাংকের ঋনের কারন দেখিয়ে বাড়িটি হাতিয়ে নিয়েছে তার এক আতœীয়। যুদ্ধের সময় তার সম্ভ্রম আর জীবন বাঁচাতে দূর্গাপুরের এক আতœীয়ের বাড়িতে রেখে এসে ছিলেন স্বামী জলিল শাহ। এই সুযোগে রাজাকার আল বদররা এই বাড়িটিকে দখলে নিয়ে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতো। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলে দেওয়া হতো প্রমত্ত পদ্মায়। এসব এখন শুধুই স্মৃতি।
সুখেই দিন কাটছিল আনোয়ারার। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টেকেনি তার কপালে। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার লক্ষে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিয়ের মাত্র ৭ বছরের মাথায় পাকিস্থান হানাদার বাহিনির বুলেট কেড়েনেয় জলিল সাহের প্রান। নিমিসেই নিভে যায় আনোয়ারার সুখের প্রদীপ। সেদিনের সেই দঃুসহ স্মৃতি নিয়ে নিঃসঙ্গতায় আজো বেঁচে আছেন নিঃসন্তান আনোয়ারা।
তিনি বলেন, দেশকে ভালোবেসে প্রান দিয়েছিল আমার স্বামী জলিল শাহ। আর স্বামীকে ভালোবেসে ৭৭ বছর বয়সে আজো অনাহার অধ্যাহারে একা দিন কাটাচ্ছি। তিনি বলেন,পাকিস্থানী হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে আমাকে রেখে এসে ছিলেন দূর্গাপুরের এক আতœীয়ের বাড়িতে। শেষ দেখায় বলেছিল, বঙ্গবন্ধসহ দেশকে বাঁচাতে যাচ্ছি, হয়তো আর দেখা হবেনা। সেদিনের সেই কথাগুলো আজো স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে। কান্নাজড়িত কন্ঠে আনোয়ারা বলেন, বুকে পাথর চেপে রেখেছি বাবা। শুধু এটুকু ভেবে যে, আমার স্বামীর রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। সবাই বিজয় উল্লাস করছে। বাতাসে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা। এতেই আমার সুখ।
স্বামী হারিয়ে নিরুপায় আনোয়ারা জীবন জীবীকার তাগিদে এক সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোমিও ঔষধ বিক্রি করতেন। সে সময় এলাকায় ডাক্তর নানী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই হতভাগিনীর জীবন গাড়ীর চাকা আজ থেমে যাওয়ার পথে। নানান রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীর জুড়ে। বেঁচে থাকার প্রচন্ড ইচ্ছায় প্রতিবেশীদের কাছে হাত পেতেই চলে তার জীবন।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও নিঃসন্তান আনোয়ারার ভাগ্যে জোটেনি সরকারী বেসরকারী কোন অনুদান। সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান বলেন, এখনি সময় আনোয়ারাদের জন্য কিছু করার। এসব অবহেলিতদের পাশে এসে দাঁড়াতে সরকার এবং বিত্তবানদের প্রতি আহবার তাদের। সচেতন মহলের প্রশ্ন, প্রমত্ত পদ্মার পানে শুধুই কি নিরবে নিভৃতে চেয়ে থাকবে আনোয়ারা? বিজয়ের আনন্দ উল্লাস ধ্বনীতে হারিয়ে যাবে কি তার হাহাকার ? জলিল শাহের মত লাখো শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা কখোনও কি উড়বে বস্তির জরাজির্ণ কুড়েঘরে?