সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – অটিজম কি? এটা কি বাবা মায়ের পাপের ফল? না কি অন্য কিছু? একটা শিশু যখন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথীবিতে আসে, তখন তাকে ঘিরে গড়ে উঠে অনেক সপ্ন। কিন্তু এই শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন দেখা যায় যে সে অন্যদের থেকে আলাদা, তার বিকাশ ঠিকমত হচ্ছেনা, তখন তৈরি হয় ভয়ানক দুশ্চিন্তা। সমাজে এজন্য মাকে দোষারোপ করা হয়। পরিবারকে দোষারোপ করা হয়। আবার অনেকে মনে করেন এটা মনে হয় বাবা মায়ের পাপের প্রায়শ্চিত্য! কিন্তু এগুলো সবই ভুল ধারণা। আর এ সময় অভিভাবকরা ঠিক বুঝে উঠেন না তখন কি করা দরকার, কোথায় যাওয়া দরকার। আর এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধের উপায়ই বা কি। এসব বিষয়সহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে সম্প্রতি টিম মেডিভয়েস কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) পরিচালক, প্রথিতযশা চিকিৎসক, অধ্যাপক ডা. শাহীন আখতারের সাথে। মেডিভয়েস: প্রথমেই আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্ক জানতে চাই? ডা. শাহীন আখতার: আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করি। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ তৎকালীন আইপিজিএমআর থেকে। মেডিভয়েস: আপনিতো অটিজম নিয়ে কাজ করেন, অটিজমের কারণ কি? ডা. শাহীন আখতার: সত্যি বলতে কি অটিজম ঠিক কেন হয় বা এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো উদঘাটিত হয়নি। তবে এটা বলতে পারি যে, জেনেটিক কারণে হয়। এখানে অনেকগুলো জিন কারণ হিসেবে থাকতে পারে। এছাড়া পরিবেশগত কারণেও অটিজম হতে পারে। মূলত এসব কিছু মিলিয়েই হয়। তাই ঠিক একটা কারণে অটিজম হয় এমনটা বলা কঠিন। আর এটার কারণ বের করতে এখনো অনেক গবেষণামূলক কাজ চলছে। মেডিভয়েস: অটিজম ছাড়াও নিউরো ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আপনাদের কি কার্যক্রম আছে? ডা. শাহীন আখতার: শুধু অটিজম না, সরকারের পক্ষ থেকে নিউরো ডেভেলপমেন্টের সবগুলো বিষয়কেই অ্যাড্রেস করা হয়েছে। অন্য নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার, যেমন সেরেব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজএবিলিটি এই সবগুলো নিয়েই আমরা কাজ করে আসছি। আমাদের ইপনাতে (INPA) ইন্সটিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম) অটিজম নিয়ে যেমন শিশুরা আসছে তেমনি সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম বা অন্য কোনভাবে পিছিয়ে পড়া শিশু, এমনকি অটিজম না কিন্তু কথা বলতে পারে না বা কানে না শোনার কারণে কথা বলতে পারে না, তারাও আসছে। এপিলেপ্সি নিয়েও রোগীরা আসে। এছাড়া অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল রোগ যেমন মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিসসহ আরো জটিল নিউরোলজিক্যাল সমস্যা নিয়েও আমাদের আউটডোরে রোগীরা আসে। আমাদের ইনডোরও আছে। সেখানে জটিল রোগী ভর্তি থাকে। মেডিভয়েস: নিউরোডেভেলপমেন্টাল রোগের প্রতিরোধের উপায় আছে কি না? ডা. শাহীন আখতার: প্রতিরোধের উপায় অবশ্যই আছে। মায়ের যদি অপুষ্টি থাকে, মানসিক রোগ থাকে তাহলে শিশুর গর্ভকালীন বিকাশ ঠিকমত হয় না। তারপরে যদি শিশু দেরিতে কাঁদে, ব্রেইনে অক্সিজেন না যায়, পরিচর্যা ঠিকমতো না হয় তাহলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়ে যায়। মা গর্ভকালীন সময়ে কি ওষুধ খেলো, মায়ের কোন ইনফেকশন আছে কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই জন্মের আগে থেকেই যদি পরিচর্চা শুরু করা হয়, মাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। জন্মের পরে শিশুকে না খাওয়ানো, শিশুর খিচুনি বা ইনফেকশন- এই বিষয়গুলোর সমাধান যদি যথাসময়ে করা যায় তাহলে নিউরোডেভেলপমেন্টাল রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর অটিজমের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে, সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হলে, অটিজমের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই বলা যায় যে, অটিজম প্রতিরোধে শিশুর জন্মের আগ থেকে জন্মের পর পর্যন্ত অনেক কিছু করার আছে ।
মেডিভয়েস: অটিজম দ্রুত ডায়াগনোসিস করার উপায় কি?
ডা. শাহীন আখতার: শিশুর বিকাশ কেমন হচ্ছে তা লক্ষ্য রাখা দরকার। এটা বাবা মা সচেতন হলে সম্ভব। মনে রাখতে হবে যত দ্রুত শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল।
মেডিভয়েস: অটিজম শিশুদের বিষয়ে পরিবার এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?
ডা. শাহীন আখতার: অনেকেই মনে করেন এরা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। আসলে তারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নয়। তারপর সমাজে এজন্য মাকে দোষারোপ করা হয়। পরিবারকে দোষারোপ করা হয়। আবার অনেকে মনে করেন এটা মনে হয় বাবা মায়ের পাপের প্রায়শ্চিত্য। কিন্তু এগুলো সবই ভুল ধারণা। এগুলো দূর করতে হবে। অটিজম আক্রান্ত শিশুকে অনেক সময় দিতে হবে। এই সময় দেয়ার অর্থ পাশে বসে থাকা নয় বরং তার সাথে ইন্টারঅ্যাকটিভ হতে হবে। অটিজম এমন একটা সমস্যা যেটা ছয়মাস-নয়মাস ধরে ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যাবে এমনটা নয়। এ বিষয়গুলো পরিবারকে ভালো করে জানাতে হবে। শুধু মা বাবা না, পরিবারের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের আরো যারা থাকে – ভাই বোন দাদী নানী সবাই মিলে একসাথে সময় নিয়ে কাজগুলো করতে হবে। শিশু কেন কথা বলছে না, কেন আমার দিকে তাকাচ্ছে না, এগুলা শুরুতেই শনাক্ত করে ডাক্তার দেখাতে হবে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত মনে করা হয়, শিশু এখনো কথা বলছে না, হয়তো বড় হয়ে কথা বলবে। যখন একটা শিশুর নিউমোনিয়া বা জ্বর হয় তখন কিন্তু আমরা দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যায়, অথচ এই বিষয়টি শিশুর ছোটকাল থেকেই ডাক্তারের নিয়ে যাওয়া উচিৎ।