ডাঃ কৃষ্ণ রায় – বাংলাদেশের কতভাগ মানুষ জানেন ডাক্তাররা কিভাবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হন? হয়তো সর্বোচ্চ শতকরা পাঁচ ভাগ! আমার বন্ধুরা মাঝেমাঝে বলে ‘তুই কি কি বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ হলি? তারও আগে বলতো ‘তুই কি বিষয়ে এমবিবিএস করলি?’ আমার শিক্ষয়িত্রী মায়ের ধারণাই ছিলনা এমবিবিএস এর পর আরো কোন পড়াশুনার দরকার পরতে পারে। আমি জিজ্ঞাসুদের বলি ‘আমি মনোরোগ নিয়ে পড়াশুনা করছি, এটা পাঁচ বছরের কোর্স। তবে পাঁচ বছরেই শেষ হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নাই’। উত্তরে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করে, যেন বিষয়টি অনেকখানি অবিশ্বাস্য, এমবিবিএস এর ছয় বছরের পর আবার আরো অন্তত পাঁচ বছর! ডাক্তার’দের যে সরকারি চাকরিতে ঢুকতে সবার মত বিসিএস দিতে হয় এটা কতভাগ মানুষ জানেন? বিস্ময়কর মজার ব্যাপার হচ্ছে সরকারি বড় বড় নীতিনির্ধারকরাও ভুলে যান ডাক্তার’দেরও বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে আসতে হয়।
আমরা যখন সরকারি চাকরিতে যোগদান করি অদ্ভুত এক রহস্যময় কারণে অনেক মানুষের ধারণা হয় ডাক্তার’দের সরকার বোধহয় বেশি বেতন এবং আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধা দেয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একজন ডাক্তার যখন সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, তখন তার পোস্টিং হয় ইউনিয়ন পর্যায়ে। তিনি সেখানে কিভাবে থাকবেন, কিভাবে যাবেন, এসিস্ট্যান্ট পাবেন কিনা কিছুই ঠিক থাকেনা। এইযে তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে ইউনিয়নে পোস্টিং পেলেন এখানেই কেটে যেতে পারে সমস্ত চাকরিজীবন! যদিনা কপালগুণে অথবা অন্যকোন গুণে চাকরির শেষ দিকে একটি-দুটি পদোন্নতি পেয়ে যান। বিশেষজ্ঞ করেননি বলে পদোন্নতি পাবেননা এটা ক্যাডার সার্ভিসে অবিশ্বাস্য। কারণ পদোন্নতির জন্য অতিরিক্ত ডিগ্রী কোন আবশ্যিক শর্ত নয়।
সরকারি ডাক্তার’দের বিশেষজ্ঞ কোর্সে আসতে হলে আগে গ্রামে অন্তত দুই বছর সেবা এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষায় পাশ করে তবেই সেই সুযোগ তৈরি হয়। এরপর যে বিশেষজ্ঞ চুড়ান্ত পরীক্ষা তাতে পাশের হার তা অত্যন্ত আতঙ্কজনক(এফসিপিএস চুড়ান্ত পরীক্ষা পাশের হার কোন কোন সময় নাকি ৫-১০%)! বিশেষজ্ঞ ডাঃ হবার পরও পদোন্নতি নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা এবং হতাশা। সরকারি চাকরি তথা বিসিএস পরীক্ষায় পাশ না করতে না পারা কেউ বিশেষজ্ঞ হতে চাইলে তাকে সরকারি হাসপাতালে চার বছর বিনা বেতনে শ্রম দিতে হবে!
আমাদের সমাজের প্রচলিত ট্রেন্ড অনুযায়ী ছেলেমেয়ে পড়াশুনায় ভালো করলে বিজ্ঞানে পড়বে এবং মেডিকেল-বুয়েটে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। মেডিকেল-বুয়েট-ঢাবিতে চান্স প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের সমাজ একটু আলাদা সমীহের চোখে দেখতে চায়, যা আবার সেই সকল ছাত্রছাত্রীদেরকে কিছুটা হলেও আত্মম্ভরি করে তোলে। আত্মম্ভরিতার অনেক খারাপ গুণের মধ্যে প্রত্যাশা পূরণ না হলে সহজেই হতাশায় ডুবে যাওয়া অন্যতম। এদেশে প্রকৌশলীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক যদিও বিদেশে তারা অত্যন্ত সফল! তুলনামূলক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই ভালো আছেন এবং সারাদেশের সব সেক্টর সহ দেশকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এইযে ডাঃ’রা বিশেষজ্ঞ হতে অতিরিক্ত অন্তত পাঁচ বছর পড়াশুনা করলো তার আর্থিক মূল্য কি? সরকারি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমফিল/পিএইচডি না করেও অধ্যাপক হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সরকারি চাকরিজীবীদের চাইতে ছয় বছর বেশি চাকরি করতে পারেন এবং উচ্চতর গ্রেডের মর্যাদা পান। বিচারপতিদের অভিজ্ঞতার মূল্য বেশি তাই তারা আট বছর বেশি চাকরি করতে পারেন। বিস্ময়কর ব্যাপার শুধু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার’দেরই অভিজ্ঞতার মূল্য নাই। নাই আমলা, পুলিশ কিংবা চাকরিজীবীদের মত বৈধ সরকারি সুবিধা কিংবা অবৈধ আয়েরও সুযোগ। পুঁজিবাদী সমাজে বেচারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার’এর শেষ সম্বল ব্যক্তিগত চেম্বার জমানো।
ব্যক্তিগত চেম্বারে তিনি সেবা দিচ্ছেন কিন্তু তা একান্তই আর্থিক ভাবনা ভেবে। এতে কেউ কেউ কখনো কখনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অন্যায় আবদারে সাড়া দিচ্ছেন, ফার্মাসিউটিকল কোম্পানির প্রলোভনে নৈতিকতা হারাচ্ছেন, কখনো কখনো নিজেরাই ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক মালিক দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। এটা এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগীতা যা অনেকাংশে ডাক্তার’দের হতাশা, বঞ্চনার ক্ষোভ থেকে তৈরি হয়েছে। এ সমাজে বিশুদ্ধ কোন পেশা নাই, সম্ভবও নয় হয়তো। সমাজের মানুষ চিকিৎসা পেশাকে মহান হিসেবে দেখতে চান, চিকিৎসকেরাও সেই আস্থার প্রতিদান দিতে চান কিন্তু প্রতিকূল সিস্টেম এবং পুঁজিবাদী সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এই প্রতাশার মাঝে শক্ত প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়ে আছে।