সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – ধানের ন্যায্য মুল্যের অভাবে কৃষকের ঘরে নাই ঈদ উৎসবের আনন্দ। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে আনন্দে ভাসছে বাংলাদেশ। শ্রমজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবাই কমবেশি সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত। শুধু ঈদ আনন্দ নেই প্রায় ১ কোটি ক্ষুদ্র কৃষকের ঘরে। কেনা হয়নি নতুন জামাকাপড়। ধানের কম দামে কৃষক পরিবারের বাচ্চাদের ঈদ আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে।
প্রতিটি ঈদ‘কে ঘিরে চাঙ্গা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। ধানের দাম কম হবার ফলে কৃষকের হাতে টাকা না থাকায় এবার ঈদকেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে চলছে আনন্দের পরিবর্তে মন্দাভাব। ধান কাটার মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানান ধরনের মেলা হয়। এবার এসব গ্রামীণ মেলাও বসেনি। ধানের দরপতনের প্রভাব পড়েছে ঈদবাজারেও। ঈদে জমেনি গ্রামীণ বাজারে কেনাকাটা।
এবার ধানের ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম নেই। বাজারে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচের অর্ধেকই উঠছে না। প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষ করে সাড়ে ছয় হাজার টাকা লোকসান গুনছেন কৃষক। এর মধ্যেই অনেক কৃষক পানির দামে ধান বেচে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করেছেন। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে গরু-ছাগল বিক্রি করছেন।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের শ্রীপুরের বড় গৃহস্থ হিসেবে দু-এক গ্রামে পরিচিত আবু সামা। ঈদের সপ্তাহখানেক আগেই তার বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড় জমে। দূর-দূরান্তে থাকা ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিরা ঈদ করতে বাড়ি আসে। সবাই মিলে ঈদ উৎসবে বাড়ি মাতিয়ে রাখে। ধান বেচার টাকায় নাতি-নাতনিদের জন্য নতুন জামা কেনা হয়। মেহমানদারির আনন্দে ব্যস্ত থাকে পুরো পরিবার। এবার এসবের ছিটেফোঁটাও নেই। তিন মেয়ের জামাইকে এবার দাওয়াত দেওয়া হয়নি। ঈদে মেয়ে-মেয়ের জামাই ও নাতি-নাতনিদের নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার রীতিতে এবার বিরতি পড়েছে।
কৃষিশুমারি হিসাবে দেশে ১ কোটি ৪৫ লাখ কৃষকের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২ কোটি ৮৬ লাখ কৃষকের ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এরমধ্যে এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক আছেন। সাধারণত তারা উৎপাদিত ধানের অর্ধেকের বেশি বিক্রি করে ঋণ শোধ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন। ধানের দরপতনে ওই এক কোটি ক্ষুদ্র কৃষক ও তাদের পরিবারের পাঁচ কোটি সদস্য এখন হতাশায় ভুগছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ধান। এবার ধানের দাম নেই, ক্রেতা নেই। ফলে কৃষকের মুখে হাসি নেই। এবার কৃষকের কষ্টের ঈদ হবে। ভালো খাবার ও বাচ্চাদের জন্য কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই কৃষকের। ঈদ আনন্দ নেই এবার কৃষকের ঘরে।
‘ছওয়ালগুলো প্রতিদিন কয়, হামার জামা কুনদিন আনিবু। এই খাটিখুটি ওমার জন্য জামা কিনি দিম আর হামার (স্বামী-স্ত্রী) এইবার নতুন কাপড় হবে না।’ দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীগঞ্জ এলাকায় কৃষি শ্রমিক রফিকুল ইসলাম এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। তার পাশে থাকা আরেকজন বলেন, ‘ঈদ এইবার হবে না, পেটত নাই ভাত আর ঈদ। মুইও এখনও কিছুই কিনো নাই, দেখো শুক্রবারত টাউনত যাম। ওই ছোয়ালগুলোর জন্য কিছু নিবা হবে।’ তার নাম জানতে চাইলে বলেন, ‘নাম জানিয়া কি করিবেন? অনেকেই তো আসে আর লিখি নিয়া যায়। কই হামার জইন্যে তো কেউই কিছু করে না। ধানের দাম নাই, হামার ঈদ কেমন করি হবে? ‘
দিনাজপুরের প্রায় ৪ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারে নেই কোনো ঈদের আনন্দ। ধনাঢ্য কৃষক পরিবারের কাছেও ঈদ আনন্দ ফ্যাকাসে। দিনাজপুরে ধানের দাম না থাকার প্রভাব পড়েছে কাপড়ের দোকানগুলোতেও। বাংলাদেশ কৃষক সমিতি দিনাজপুর শাখার সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, বর্তমানে কৃষকদের মহাবিপদ। ঈদ উৎসব-আনন্দ সব মাটি।
দেশের খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁয় ঈদের জৌলুসে এবার ভাটা পড়েছে। জেলার ধামইরহাট উপজেলার দক্ষিণ চকযদু গ্রামের বর্গাচাষি মাজেদুল ইসলাম বলেন, বোরো ধান চাষ করে মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে প্রতি বিঘায় আমাকে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ঘরে ধানও রাখতে পারিনি। সংসার কীভাবে চালাব, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ কীভাবে সামলাব এই দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি। এর ওপর পাওনাদারের ভয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
যশোর সদরের মাহিদিয়া গ্রামের আব্দুল গফুরের কাছে ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘ধানের বাজার দেখে বুজতি পারছেন না চাষিগের ঈদ কিরাম হতি পারে?’। এবার তিন বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন তিনি। বাম্পার ফলনে যেমন খুশি হয়েছিলেন; ঠিক ততটাই হতাশ হয়েছেন ধান বিক্রি করতে গিয়ে। হতাশ কৃষক গফুর বললেন, ‘ধান উঠার মুখি ঈদ। ইবার ছেলেমেয়েগের দামি জামাকাপড় কিনে দেবোকি, আবাদে লোকসানের জন্যি কারো কিছুই কিনতি পারিনি। সিমাই-চিনি কিনে রাখিছি আর ঈদির আগের দিন ২/১ কেজি গোস (মাংস) কেনবো। এই দিয়েই পার করতি হবে ইবারের ঈদ।’ যশোরের গ্রামাঞ্চলে কৃষকের বেশিরভাগেরই এবার ঈদ প্রস্তুতি গফুরের পরিবারের মতোই। সদর উপজেলার তপসীডাঙ্গা গ্রামের কৃষক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সার-কীটনাশকের দোকানদাররা হালখাতার চিঠি দিয়েছে। দেনা শোধ করতে হবে, ধান বিক্রি ছাড়া উপায় কী!। আবাদের লোকসান পুষাবো কী করে সেই চিন্তায় দিশেহারা। এরমদ্দ্যি ছেলেমেয়েদের ঈদির কিনাকাটা মাথায় ঢোকছে না।’
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া গ্রামের কৃষক আতাবুর রহমান শেখ এ বছর অন্যের এক একর জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। তিনি জানান, ধানের দাম কম, এখন ধান বিক্রি করলে তাকে ১৬ হাজার টাকা লোকসান দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সামনে ঈদ, হাতে কোনো টাকা নেই। স্ত্রী, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া মেয়ে ও সাড়ে ৩ বছর বয়সী ছেলের জন্য ঈদের কোনো কাপড় কিনতে পারিনি। ঈদের দিনের জন্য বাজার করারও টাকা নেই আমার হাতে। আমাদের আবার ঈদ।’ শুধু আতাবুর রহমান নন; খুলনার প্রায় আড়াই লাখ কৃষক পরিবারে এবার ঈদের আনন্দ নেই।
ধানের দাম না পাওয়ায় এবার বগুড়ায় ঈদের কেনাকাটায় পিছিয়ে কৃষক। উপজেলা সদর থেকে জেলা শহরে মার্কেটগুলোতে কৃষক এবং তাদের পরিবারের তেমন উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। দোকানিদের ভাষ্য, এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান। সেই ধান ঘরে তোলার মৌসুমে ঈদ আসায় মার্কেটগুলোতে এবার কৃষকের উপস্থিতি বেশি হবে বলেই তাদের ধারণা ছিল। সেই অনুযায়ী তারা কাপড় ও জুতা-স্যান্ডেলসহ অন্যান্য ঈদে প্রয়োজন হয় এমন পণ্যের মজুদ বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর ধান বিক্রির টাকায় আবাদের খরচ না ওঠায় সিংহভাগ কৃষক মার্কেটে আসতে পারছেন না।
হাওর অঞ্চলেও ঈদ আনন্দ নেই। হাওরের দোকানগুলোতে বেচা-বিক্রি কম। ধান বিক্রি করেই হাওরের বিশাল জনগোষ্ঠী ঈদুল ফিতরের কেনাকাটা করেন। কিন্তু এবারে ধানের বাজার নিম্নমুখী। লোকসান দিয়ে এক মণ ধান বিক্রি করেও ঘরের গৃহিণীর জন্য একটি পছন্দের শাড়ি কিনতে পারছেন না। ইটনা উপজেলার বাদলা গ্রামের মাঝারি কৃষক হাজীর বাপ জীবনে এই প্রথম সন্তানদের জন্য কম দামে ফুটপাত থেকে পোশাক কিনেছেন। এ কথা ভেবে তাদের চোখে পানি এসে যায়। কথা হয় সচ্ছল কৃষক ফজলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে সন্তানসহ আত্মীয়-স্বজনদের নতুন কাপড় দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত থাকলেও এই প্রথম অর্থের অভাবে তা দিতে পারছি না; এই কষ্ট কোনোদিনই ভুলতে পারব না।
কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ সমকালকে বলেন, প্রতিবছর কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠান হয়। এবারও হবে। সারাদেশের কৃষকদের জন্য সমবেদনা জানানো ছাড়া তো কিছু করার নেই। কৃষকের ঈদ আনন্দময় করতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। সরকার ধান-চাল সংরক্ষণের সক্ষমতা না বাড়ালে কৃষকের ন্যায্যমূল্য, দুর্যোগ মোকাবেলা ও বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এবার কৃষকের সর্বনাশের জন্য ৬০ লাখ টন চাল আমদানি দায়ী। এখন মৌসুমে মিলাররা পাইকারদের মাধ্যমে ধান কিনছেন না। ব্যাংকে তারল্য সংকট। সবকিছু মিলিয়ে কৃষকরা এমন বিপদে পড়েছেন। তাদের কাছাকাছি থাকি, তাই তাদের কষ্টটা আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি। কৃষকরা এখন ধানের আবাদ বাদ দিয়ে উচ্চমূল্যের ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কৃষকদের ধান চাষে রাখতে হলে ভর্তুকিসহ কৃষকদের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন-দিনাজপুর থেকে বিপুল সরকার সানি, নওগাঁ থেকে এম আর ইসলাম রতন, যশোর থেকে তৌহিদুর রহমান, খুলনা থেকে মামুন রেজা, বগুড়া থেকে মোহন আখন্দ ও কিশোরগঞ্জ থেকে সাইফুল হক মোল্লা দুলু।