মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন এরদোয়ান

0
0

সৌদি আরবের অবস্থা এখন কেন যেন মুসলিম বিশ্বকে ভাঙার নেতৃত্ব দেয়ার মতোই; ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরান কিংবা কাতার এমন বহু দেশের সঙ্গে এক দ্বান্দ্বিক অবস্থায় রয়েছে দেশটি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক আলোচিত নাম ইরান, মুসলিম বিশ্বে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাবও রয়েছে দেশটির। তেহরানের সামরিক শক্তির দিকটিও স্বীকৃত, নিত্যনতুন সামরিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে খবরের শিরোনামও হচ্ছে দেশটি। কিন্তু, আন্তর্জাতিক অবরোধে ইরান জর্জরিত, জঙ্গি সমর্থনের অভিযোগ টেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা একঘরে করে রেখেছে ইরানকে।

দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে, পশ্চিমা চাপ মোকাবিলার পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ রিয়াদকেও সামাল দিতে তেহরানকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের নানান সংকটে তেহরানের কণ্ঠ উচ্চকিত। কিন্তু শিয়া রাষ্ট্র হওয়ায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জায়গাটি নিজের করে নিতে পারছে না ইরান।

যদি বলা হয় অনারব দেশের হাতেই এখন মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব, তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। সামরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্ক।

তারা সামরিক জোট ন্যাটোরও সদস্য, কামাল আতাতুর্কের আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রের নীতির কারণে তুরস্ক সম্পর্কে ইসলামি বিশ্বে এক ধরনের দ্বিধা লক্ষ করা গেছে। তবে, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আমলে তুরস্কের ভাবমূর্তির বদল ঘটছে, বিপদগ্রস্ত মুসলিমদের পাশে সর্বদা তাকে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে। তার এই বৈশিষ্ট্য দেশটিকে নিয়ে গিয়েছে মুসলিমদের কাছে এক আশ্রয়ের স্থানে।

পরপর ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী ও টানা ২য় বারের মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন এরদোয়ান। তিনি ইসলামপন্থি হিসেবেই অতি পরিচিত, রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তাকে ইসলামপন্থি আচরণ করতে দেখা গিয়েছে যার ফলে ৪ মাস জেলও খাটতে হয়েছিল এই নেতাকে।

ইস্তানবুলের মেয়রের দায়িত্বপালন থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত তুরস্কে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে কাজ করছেন তিনি। এরদোয়ানের জোর প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে ইসলামিক বিশ্বে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আঙ্কারা।

২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। অধিকতর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি। এখন তাকে অনেকে তুরস্কের নতুন সুলতান সুলেমান বলেও অভিহিত করেন। এরদোয়ান শুধু নিজ দেশের সুলতান হতে চান না, তার লক্ষ্য আরও বড়।

তিনি মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চান, এই লক্ষ্য থেকেই ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) বিভিন্ন ফোরাম ও উপলক্ষে এরদোয়ান নিজের যোগ্যতা তুলে ধরছেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে এরদোয়ান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আমি সুন্নি বা শিয়া নই, আমার ধর্ম ইসলাম।’

সৌদি আরবের আধিপত্যবাদী আচরণ মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার পরিবর্তে তাকে ক্ষতবিক্ষত করতেই বেশি পারদর্শী। যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, বিদ্যমান এই বাস্তবতায় বর্তমান বিশ্বে কোন মুসলিম দেশগুলো তাদের পূর্ব-পুরুষদের গৌরব ধরে রেখেছে। এমন জটিল অবস্থায় উত্তর পাওয়াটা খুবই মুশকিল, তবে এর মধ্যে হয়তো ৩টি দেশের নাম চলে আসবে ; সৌদি আরব, ইরান ও তুরস্ক। হ্যাঁ, ইউরেশিয়ান এই দেশটি এখন কার্যকরভাবেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে প্রতিনিধিত্ব করেছে।

সৌদি আরবের যে নেতৃত্ব নেয়ার কথা ছিল, মার্কিন বলয়ে সেই যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে নিন্দিত, সমালোচিত যুবরাজ সালমানের নেতৃত্বাধীন দেশটি। তবুও, এরদোয়ানের সামনে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব পেতে অন্তরায় রয়েছে যুবরাজ সালমান, এরদোয়ানের বিরুদ্ধে নব্য ‘অটোমান খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার অভিযোগ করেছেন। শতবছর ধরে সুন্নি সৌদি আরবীয় এবং ইরানি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত চলছে, আর এর মধ্যেই অটোমান-ওহাবি/ আল-সৌদ বৈরিতা স্তিমিত হয়ে ছিল। ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে সম্প্রতি সৌদি বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে দু-দেশের মধ্যকার উত্তেজনা ফের চাঙ্গা হয়।

মুসলিম বিশ্বের পবিত্রতম স্থান মক্কা, মদিনার অভিভাবক হওয়ার ফলে সৌদির প্রভাবকে পেছনে ফেলা খুব একটা সহজ না। তবে, মুসলিমদের সমর্থন পেতে এরদোয়ানের কাছে রয়েছে অন্য হাতিয়ার। সৌদি আরবের মার্কিন চাটুকারিতা এবং এরদোয়ানের সেই তুলনায় কম মার্কিনপন্থিতা এরদোয়ানকে মুসলিমদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। ইরান ও কাতারের সঙ্গে তুরস্কের সু-সম্পর্কও এই ক্ষেত্রে বেশ ভালো প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে এরদোয়ানকেই সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যায়। রোহিঙ্গা সংকটে এরদোয়ানের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাজ হাশমি এই মত দেন যে, এরদোয়ান তুরস্কের হারানো শৌর্যবীর্য ফিরিয়ে আনতে চান। একই সঙ্গে তুরস্ককে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তিনি হতে চান মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতা।

দক্ষিণ এশিয়ায় রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যেই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি মুসলিম বিশ্বকে একটা বড় ধরনের পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই সংকটের শুরু থেকেই যথারীতি সোচ্চার এরদোয়ান। তিনি হয়ে ওঠেন ফিলিস্তিনি তথা সারা বিশ্বের মুসলমানদের কণ্ঠস্বর। তার ভূমিকা ও তৎপরতা মুসলিম বিশ্বের নজর কেড়েছে। ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জায়গায় একটা শূন্যতা বিরাজ করছে।

সৌদি আরবের বাদশা সালমানের নেতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কার্যত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরব চালাচ্ছেন। তিনি বয়সে খুবই তরুণ। নেতৃত্বের জায়গায় আসতে তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও খুব একটা ক্যারিশমা দেখাতে পারছেন না। এখন এরদোয়ানের সামনে সুবর্ণ সুযোগ। আর এই সুযোগেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে এরদোয়ানের হাতেই চলে যাচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here