সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – বিএনপি করা অতো সহজ নই, বিএনপি করতে ম্যালা দম লাগে বাহে।আমার একধরনের শুভার্থী রয়েছেন, যারা ইদানীং সুযোগ পেলেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিএনপিতে যোগদান করে আমি মস্তবড় ভুল করেছি। শুভার্থীদের মধ্যে যারা একটু নরম প্রকৃতির, তারা অবশ্য সরাসরি না বলে একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমি আমার কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত কি না অথবা আমি কবে নাগাদ আওয়ামী লীগে ফিরে যাবো। কথাগুলো নিয়ে আমি আগে তেমন একটা রা করতাম না। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকার একটি অভিজাত ক্লাবে বেশ কিছু শীর্ষ রাজনীতিবিদ, আমলা-বুদ্ধিজীবী, দেশী-বিদেশী কূটনীতিবিদ এবং সাংবাদিকসহ অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষজনের সাথে কথা বলার পর মনে হলো, শিরোনাম প্রসঙ্গে খোলামেলাভাবে কিছু লেখা উচিত। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনীতির বাইরে লেখালেখি এবং টেলিভিশন টকশো ও সভা-সমিতি সেমিনারের বক্তা হিসেবে একটু-আধটু পরিচিতি রয়েছে।
ফলে কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করা মাত্র বেশ কিছু আগ্রহী শ্রোতা, প্রশ্নকারী এবং ভক্ত-অনুরক্ত পেয়ে যাই। পৃথিবীতে যারা দু’কলম লিখতে পারেন এবং যুগপৎভাবে বলতে পারেন, তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সব সময়ই একটু বেশি থাকে। কেউ তাদেরকে সবজান্তা সমশেরদের মতো বিরক্তিকর ও অপাঙ্ক্তেয় যেমন ভাবেন, তেমনি অনেকে আবার বেশ ইতিবাচক ধারণাও পোষণ করেন। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে সেই রাতের ক্লাব আড্ডায় কে কী ভাবছিলেন, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আমি আমার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় সম্মানিত অতিথিদের সাথে অনবরত কথা বলেই চলছিলাম। ফলে আমাদের টেবিলটি একটি জমজমাট আড্ডাখানায় পরিণত হলো। আমাদের হৈ-হুল্লোড়, কথাবার্তা ও হাসিঠাট্টার শব্দ শুনে আশপাশের টেবিল থেকে অনেক নামকরা মেহমানও চলে এলেন। ফলে টেবিলের চেয়ার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হলো।
আমাদের টেবিলের আড্ডায় যোগ দেয়া নতুন অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দেশের নামকরা একজন সাংবাদিক কাম-সম্পাদক, যিনি টেলিভিশন টকশোর একজন মেগাস্টারও বটে। আরো ছিলেন সামরিক বাহিনী থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া একজন আলোচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার কর্তা। বিএনপির রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ এবং দলটিতে যোগদান প্রসঙ্গে জেনারেল সাহেবই প্রথম আলোচনার সূত্রপাত করলেন। আমি সাধ্যমতো উত্তর দিয়ে তাকে খুশি করে দিলাম এবং তিনি আমাকে মনেপ্রাণে একজন বিএনপি নেতা বলে মেনে নিলেন। তিনি কথা বলার সময় বেশ কয়েকবার বলে উঠলেন, বিএনপি নেতা হিসেবে রনি ভাই এটা বলেছেন-ওটা বলেছেন, যার সাথে আমি একমত বা দ্বিমত পোষণ করি।
তার কথাবার্তা শুনে সাংবাদিক কাম-সম্পাদক মহোদয় কৌতুক করে বললেন- আপনার রনি ভাই আবার বিএনপি নেতা হলেন কিভাবে? বাংলাদেশে এক দল থেকে অন্য দলে গিয়ে স্থান করে নেয়া অথবা টিকে থাকা এতটা সহজ নয়। তিনি উদাহরণ হিসেবে বললেন, মতিয়া চৌধুরী এখনো আওয়ামী লীগার যেমন হতে পারেননি, তেমনি খন্দকার মোশাররফ বা ব্যারিস্টার মওদুদও পাকা বিএনপি বলে স্বীকৃতি পাননি।
সম্পাদক সাহেবের কথার মধ্যে বাস্তবতা ছিল; কিন্তু ওসব কথাবার্তা সামাজিক আড্ডার রসঘন পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। ফলে তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিষয়টি হালকা করার জন্য আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে বললাম, বিএনপির রাজনীতিতে আমি জেএসসি ক্লাসের অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র মাত্র। কাজেই আমাকে শিক্ষাপর্ব শেষ করার জন্য আগামী দিনে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, বিএ, এমএ ইত্যাদি পরীক্ষা দিতে হবে এবং লিখিত, ভাইবা এবং প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় পাস করেই প্রমাণ করতে হবে যে, আমি সত্যিই বিএনপি করি। আমার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। ফলে যেখানে আড্ডার পরিবেশ পুনরায় ফিরে এলো।
সে দিনের আড্ডায় যে কথাগুলো বলতে পারিনি তা আজ অবলীলায় বলার চেষ্টা করব। আমি মনে করি, আমাদের দেশের রাজনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে আমি আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের রাজনীতির কালাকানুন, দুর্বোধ্য সময় এবং নিকৃষ্ট পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জেনেছি তাতে সর্বত্রই দেখেছি যে, রাজনৈতিক স্বার্থ-হানাহানি ও মারামারি সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনেরা মানবতা বিসর্জন দেননি এবং প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার প্রত্যয় নিয়ে ছলাকলার সর্বোচ্চ মুদ্রা ব্যবহার করেননি। বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ কিংবা বেগম জিয়ার শাসনামলে এমন বহু দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা রয়েছে যখন রাষ্ট্রশক্তি ক্ষমতাসীনদের যমদূত বলে খ্যাত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে নিরপেক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং মানবিক আচরণ করেছে। অন্য দিকে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনেকে প্রতিপক্ষের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতেন।
অতীতকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটেছে, যা বর্তমান জমানায় রীতিমতো অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। সমকালীন রাজনীতিতে যে কয়জন সিনিয়র রাজনীতিবিদ রয়েছেন, তাদের মধ্যে কর্নেল অলিকে আমার সব্যসাচী রাজনীতিবিদ বলে মনে হয়। একজন রাজনীতিবিদের যেসব সাধারণ গুণের পাশাপাশি দুর্লভ গুণাগুণ ও যোগ্যতা থাকা দরকার, তার প্রায় সবগুলোই তার মধ্যে বিদ্যমান। তার সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব, সাহস, উঁচু মার্গের শিক্ষাদীক্ষা, সততা ও গণমুখী চরিত্র নিয়ে তিনি কোনোকালে দালালি করেছেন বলে আমার মনে হয়নি। বরং অকপটে সত্য বলার দুরন্ত সাহস, ক্ষমতাসীনদের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রয়োজনে বিদ্রোহ করার যোগ্যতা এবং মানুষের বিপদে সাহায্য করার দুরন্ত বাসনার যেসব কথাবার্তা আমি শুনেছি তাতে তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারিনি।
কর্নেল অলি যে সময় বিএনপি ত্যাগ করছেন তখন তা করার জন্য বুকভরা সাহস এবং শরীরভরা হিম্মত না থাকলে কেউ ওসব কাজে এক পা এগোতে পারে না। পরবর্তীকালে বিএনপির বিপদে তিনি যেভাবে বারবার এগিয়ে গেছেন তা কেবল সাহসী বীরেরাই পারে। কোনো দুর্বলচিত্তের লোভী বা হিংসুটে স্বার্থপর দালালের পক্ষে কর্নেল অলিদের মতো লোকের দলত্যাগ বা পূর্বতন দলকে সাহায্য করার অভিলাষ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কর্নেল অলির মতো সব্যসাচী না হলেও বাংলাদেশের ধ্রুপদী রাজনীতিতে মতিয়া চৌধুরী নিঃসন্দেহে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৭৫ সাল-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের যখন মহাদুর্দিন চলছিল, ঠিক তখন মতিয়া চৌধুরী যেভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন তার জন্য অতি উঁচু মার্গের সততা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টির পাশাপাশি সাহস ও শক্তি দরকার হয়। কোনো মৌ লোভী শৃগাল চরিত্রের স্বার্থপর এবং অল্পবিদ্যার মানুষ মতিয়া চৌধুরীর রাজনীতি নিয়ে মূল্যায়ন করতে পারে না।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে মৌলিক আদর্শগত পার্থক্যের ক্ষেত্রে ষাট অথবা সত্তরের দশকে যেসব বড় বড় নীতিকথার প্রচলন ছিল, তা বর্তমানের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একেবারে অচল। বর্তমানের ধনতান্ত্রিক দুনিয়া, বুর্জোয়া বাজার ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তি, নিদারুণ প্রতিযোগিতা এবং উন্নত জীবনযাপনের নিষ্ঠুর অভিলাষ মানুষকে যান্ত্রিক বানিয়ে ফেলেছে। মানবিকতা, বিনোদন, রাজনীতি, ধর্মকর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-নিদ্রা এবং পারিবারিক জীবনযাপনে ২০১৯ সালের বাংলাদেশের সাথে ষাট বা সত্তর দশক তো দূরের কথা মাত্র পাঁচ বছর পূর্বেকার বাংলাদেশেরও কোনো তুলনা করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজের ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র, প্রকৃতি-পরিবেশ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কোনো কিছুই আর গতকালের মতো চলতে চাচ্ছে না বা পারছে না। প্রতিদিনই নতুন ঘটনা ঘটছে এবং নতুন বাস্তবতার সাথে সবাইকে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে।
উপরোল্লিখিত বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতির ইদানীংকালের ধরন-ধারণ দেখে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়তো ভাবেন- কী দরকার ছিল একটি গুলিস্তান-কেন্দ্রিক আন্দোলনের কাছে মাথা নত করে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার! কেন তিনি পতনের আগে রাজভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে গুম-খুন-সন্ত্রাস চালিয়ে বিরোধীদেরকে স্তব্ধ করে দেননি অথবা দেশী-বিদেশী কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে রাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, জ্বালানি-খনিজসম্পদ, শেয়ারবাজার ইত্যাদি সমর্পণ করে কেন ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করলেন না! কেন তিনি মুখরা রমণীর মতো অকপটে তথ্যপ্রমাণসহ বলে দিলেন না যে, রাতের আঁধারে কারা কোন ছন্দবেশ নিয়ে তার কাছে আসত এবং কত টাকা দাবি করত এবং সেই টাকা আবার কিভাবে গুনে নিত!
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখন খুবই বয়োবৃদ্ধ। জীবনসায়াহ্নে এসে তার আরো কী সব কথাবার্তা মনে হয়, তা নিয়ে আলোকপাত না করে আমরা বরং কারাবন্দী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আফসোস নিয়ে কিছু কল্পকাব্য রচনা করতে পারি। তিনি হয়তো বর্তমান বাস্তবতায় ভাবতে পারেন, রাষ্ট্রপতিশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা বাদ দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা তার ঠিক হয়নি। অথবা স্যার স্টিভেন নিনিয়ান যখন এসেছিলেন তখন আওয়ামী লীগের সাথে যে সমঝোতার খসড়া তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে হরতাল করা যাবে না শর্তটি অন্তর্ভুক্ত করে সমঝোতা ভেঙে দেয়া মারাত্মক ভুল ছিল। বিএনপির রাজনীতিতে যাকে সবাই নাট্যবালক বলে ঠাট্টা-মশকারা করতেন, তার কথামতো অপ্রয়োজনীয় শর্তারোপ এবং তার ব্যক্তিগত চাকর-বাকরদের শেষ মুহূর্তের প্ররোচনায় তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরে যে গড়িমসি দেখিয়েছিলেন, যার ফলে সরকারের পতন হয়েছিল এবং সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছিল। অন্য দিকে সুবিধাবাদীরা বাক্সপেটরা নিয়ে সবার আগে নিরাপদে ভোঁ-দৌড় মেরে বিদেশে চলে গিয়েছিল।
বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতা হলো, তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন জেলে এবং তার জমানার প্রধান সুবিধাভোগীরা সবাই নিরাপদে প্রবাসজীবনে বিত্তবিলাসে গা ভাসিয়ে দেশে অবস্থানরত বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীদের দুর্ভোগ-দুর্দশা নিয়ে কটাক্ষ করার পাশাপাশি এসব কথাও বলে বেড়াচ্ছেন যে, ’এদেরকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না- আজ যদি আমরা দেশে থাকতুম তবে দেখিয়ে দিতুম আন্দোলন কাহাকে বলে!’
প্রবাসে পালিয়ে যাওয়া বিএনপি দলীয় সুবিধাবাদী এবং দুর্নীতির বরপুত্ররা উঁচুগলায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সমালোচনা করছেন এবং বিভিন্নজনকে ফোন করে বিভেদ-বিসম্বাদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। দেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে গত প্রায় ১০টি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। দলের একসময়ের তেজি যুবকেরা গত ১০ বছরে বৃদ্ধতে পরিণত হতে চলেছেন। সিনিয়র নেতাদের অনেকে রাজনৈতিক জীবন এবং পৃথিবী সম্পর্কে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে কবরে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সম্মানজনক মৃত্যুর জন্য বিধাতার দরবারে আকুতি জানাচ্ছেন। দলের শুভার্থী, সাধারণ কর্মী ও সমর্থকেরা সরকারি জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে পিঠ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১০ বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনপির রাজনৈতিক জোটে ফাটল সৃষ্টির পাশাপাশি জোটের প্রধান দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতকে রাজনীতির মাঠ থেকে কিক-আউট করে দেয়ার জন্য এবং তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ করার জন্য তারা করেনি এহেন কর্ম নেই। রাষ্ট্রশক্তি, বিদেশী তাঁবেদার এবং নিজেদের পেশি ও অর্থবলে আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতাকর্মীদের ধমনি, লোমকূপ ও হাড়ের সংযোগস্থলে রাজনীতির বেদনা ও কষ্ট অত্যন্ত সফলতার সাথে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের মন-মস্তিষ্ক এবং বেঁচে থাকার আগ্রহের মধ্যে ভয়-দ্বিধা-সন্দেহ ইত্যাদিও সমানতালে ঢোকানো হয়েছে। এ অবস্থায় পৃথিবীর কোনো জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায় স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো তো দূরের কথা, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্নও দেখতে পারে না। তারা অতিমাত্রায় নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ে এবং দৈবাৎ প্রাপ্তির আশায় দিনাতিপাত করে। এমন এক বাস্তবতার মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে যুক্তফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি রাজনৈতিক সমীকরণ হয়; যার ফলাফল দিবালোকের মতো আগামী দিনের ইতিহাসের বইতে লেখা থাকবে এবং অতীতের সব কুকর্মের ওপর গভীরতর অন্ধকারের ছায়া বিছিয়ে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে।
একজন নগণ্য লেখক এবং সংবেদনশীল ইতিহাসের পাঠক হিসেবে আমি গত ১০ বছর থেকে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। আমি অনেকের মতো নিজেকে নিয়তির কাছে সঁপে দিইনি। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি এবং প্রবল ক্ষমতাধরদের নিকটজন হওয়া সত্ত্বেও সুবিধাভোগী দালাল, তাঁবেদার বা স্বার্থান্ধ চাটুকার হয়ে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা ও পদ-পদবি বাগানোর চেষ্টা করিনি। আমার রাজনৈতিক সৌভাগ্যের তারকা যখন মধ্যগগনে জ্বলজ্বল করছিল- তখন আমি কর্নেল অলি আহমদের মতো সাহস ও হিম্মত নিয়ে সদলবলে দলত্যাগ করে নতুন দল গড়তে পারিনি। তবে দলের মধ্যে থেকে যথাসম্ভব সাহস-শক্তি নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লিখিত ও মৌখিকভাবে বিরোধিতা করেছি।
২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, অংশগ্রহণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত ক্রয় করিনি। অন্য দিকে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশার পেছনে মূল কারণ ছিল- আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে, একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়তো প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক হবে; কিন্তু যেই মুহূর্তে মনোনয়নবঞ্চিত হলাম এবং আমার পরিবর্তে যাকে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করা হলো তখন ধরেই নিলাম যে, নির্বাচন তো হবেই না, বরং নির্বাচনের নামে এমন প্রহসন হবে, যা ২০১৪ সালের ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
উপরোল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হুট করে বিএনপিতে যোগ দেয়া আমার জন্য কোনো সহজ-সরল সাধারণ ঘটনা ছিল না। আত্মমর্যাদা রক্ষা, রাজনৈতিক বোধ ও বুদ্ধিকে টিকিয়ে রাখা এবং আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনে বিএনপিতে যোগ দেয়াই আমার কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। আমি আমার সম্ভাব্য পরিণতি এবং বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন ছিলাম এবং এখনো আছি। আমি হয়তো এ দেশের ধ্রুপদী রাজনীতিতে মতিয়া চৌধুরীর মতো প্রসিদ্ধ কেউ নই- তবে আমার অবস্থান একেবারে ফেলে দেয়ার মতো বা তাচ্ছিল্য করার মতো নয়। বিএনপির চরম দুঃসময়ে যখন দলটির সুবিধাভোগীরা দেশ-বিদেশে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে তখন সব কিছু জেনে এবং বুঝে সেই দলের কর্মী হিসেবে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়ানোর মধ্যে আর যাই হোক- কোনো স্বার্থ অন্তত নেই।