সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নার্সের সিজারে নবজাতকের মৃত্যুর খবর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওই প্রসূতিকে সিজারই করা হয়নি। বাচ্চা মায়ের গর্ভে দুই দিন আগেই মারা গিয়েছিল। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা অপারেশন করান উল্লেখ করে তারা বলেন, মেডিকেল অফিসাররা পর্যন্ত অপারেশনের সুযোগ পান না। সুতরাং এই অবস্থায় কোনো নার্সেরই সিজার করার বিষয়টি একেবারেই অবান্তর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) জানান, সরকারি কোনো হাসপাতালে নার্সরা অপারেশন করবে এটা একেবারেই অসম্ভব। মেডিকেল অফিসাররা পর্যন্ত অপারেশন করতে সুযোগ পাননা, সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার হয়। এমনকি ফার্মেসিতে ডিপ্লোমাধারীরা হাসপাতালে ওষুধ প্রদান করেন।
তিনি আরও বলেন, “নার্স হাত দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই রোগীকে (প্রসূতি) কিছুই করা হয়নি। তার বাচ্চার গলা বের হয়ে গিয়েছিল। মানুষ মৃত্যুর পরে ফুলে যায়। পেটের ভেতরে বাচ্চাটা ফুলে গিয়েছিল। বাচ্চাটা বের হচ্ছিল না। তখন চিকিৎসকরা ওই বাচ্চার জন্য আর অপারেশন করতে চাননি। সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে গেছে আল-হামরা ক্লিনিকে। পরে সদর হাসপাতালের নামে বদনাম করে একটি নিউজ করে দিলো।”
“বাচ্চাটা মায়ের গর্ভে দুই দিন আগেই মারা গেছে। তারা গর্ভাবস্থায় কখনো ডাক্তারের কাছে আসেনি, আল্টাসনোগ্রাম করেনি, রক্তের মাত্রা দেখেনি, রক্তশূন্যতা ছিল”, যোগ করেন ওই ইউএইচএফপিও।
সূত্র জানিয়েছে, গর্ভের শিশুর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই প্রসূতিকে গত ১৪ জুলাই ভোর ৬টার দিকে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির আগে দুই দিন বাড়িতে রেখে ডেলিভারির চেষ্টা করানো হয়েছিল, যেটা রোগী ভর্তির সময় স্বজনরা স্বীকার করেছেন।
প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির পর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হাসপাতালের একজন গাইনি কনসালটেন্ট তাকে দেখেন। ওই সময় রোগীর ব্যথা ছিল এবং তার জরায়ু মুখ প্রায় ৮ সে. মি. প্রসারিত ছিল (সাধারণত ১০ সে. মি. প্রসারিত জরায়ু মুখকে পূর্ণ প্রসারিত ধরা হয় এবং এই প্রসারণে স্বাভাবিক ডেলিভারির শেষ পর্যায় শুরু হয়)। প্রসূতির মেমব্রেনও (জরায়ুর মধ্যে যে থলির ভেতরে বাচ্চা থাকে) রাপচার্ড ছিল (ডেলিভারির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই এটা ঘটে থাকে)।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, “ওই সময় পরীক্ষা করে গর্ভস্থ শিশুর হৃদস্পন্দন পাওয়া যায়নি। তাই শিশুটিকে চিকিৎসক মৃত বলে ধারণা করেন। তাছাড়া পরীক্ষা করে শিশুটির আকার বড় বলেও সন্দেহ হয়।”
এ অবস্থায় স্বজনকে রোগীর সার্বিক অবস্থা জানিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, প্রসব ব্যথা বাড়লে এবং জরায়ুমুখ আরো কিছুটা প্রসারিত হলে রোগীর নরমাল ডেলিভারিই হবে। এ ধরনের বৃহদাকৃতি এবং মৃত শিশুর ডেলিভারিতে মায়ের প্রচুর রক্তক্ষরণের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য রক্ত জোগার করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, “দুপুর দেড়টার দিকে লেবার (ডেলিভারি প্রক্রিয়া) প্রোগ্রেস করায় রোগীকে লেবার রুমে (স্বাভাবিক ডেলিভারির জন্য বিশেষভাবে সজ্জিত রুম) নেয়া হয় এবং নার্সরা প্রসূতির প্রসব প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে থাকেন। যেমন: প্রসব-ব্যথার প্রতিটি ঢেউ আসার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর জরায়ুমুখের দু’দিকে হাত দিয়ে চেপে প্রসারিত করার চেষ্টা, রোগীকে তলপেটের চাপ বাড়ানোর জন্য বলা, ক্যাথেটার করিয়ে রোগীর প্রস্রাবের থলি খালি করা, এবেনা দেয়ানোর ব্যবস্থা করে রোগীর মলনালী খালি করানো, প্রয়োজনে হাত দিয়ে পেটে চাপ প্রয়োগ করা ইত্যাদি।”
ওই প্রসূতির সিজার করা হয়নি জানিয়ে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পার্থ সারথি দত্ত কানুনগো বলেন, “হাসপাতালে নিয়ে আসার দুই দিন আগে থেকে বাচ্চাটির নড়াচড়া ছিলো না। বাচ্চা যদি মায়ের গর্ভে মারা যায় তাহলে অনেক সময় ফুলে যায়।”
তিনি আরও জানান, “ওই দিন গাইনির নিয়মিত ওটি ডেইট থাকায় হাসপাতালের তিনজন গাইনোকলজিস্টের সবাই ওটিতে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন হাসপাতালে সিজারিয়ান, হিস্টেরেকটমি (জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া) ও ডিএন্ডসি ইত্যাদি মিলিয়ে মোট নয়টি অপারেশন হয়।”
চিকিৎসকরা বলেন, “ওটি চলার এক পর্যায়ে দুপুর প্রায় দুইটার দিকে নার্সরা গাইনি চিকিৎসকদের জানান, বাচ্চার মাথা বের হয়ে এসেছে। কিন্তু কাঁধ আটকে গেছে। তখন একজন গাইনোকলজিস্ট ওটি থেকে বের হয়ে লেবার রুমে গিয়ে রোগীকে দেখেন। এ সময় তিনি দেখতে পান, বাচ্চাটার মাথা বের হয়ে এসেছে এবং দুই কাঁধ আটকে আছে, ব্যথার ঢেউয়ের সঙ্গে নিচে নামছে না এবং বেরও হচ্ছে না। তিনি লক্ষ্য করেন, বাচ্চাটির মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে বড় এবং সেটা ফোলা এবং ঘাড়ের চামড়া খুবই নরম হয়ে আছে, যা থেকে বোঝা যায়, শিশুটি গর্ভেই মারা গিয়ে তার দেহের চামড়ায় পচন শুরু হয়েছে। এ সময় তিনি আরেকজন গাইনোকলজিস্টকে ওটি থেকে ডেকে পাঠান। তারা দেখতে পান, বাচ্চার কাঁধের চামড়া শোল্ডার জয়েন্টের উপরে ছিলে গেছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে করণীয় নিয়ম অনুযায়ী বাচ্চাটির একটি কাঁধ বের করে আনার চেষ্টা করেন এবং সফল হন তারা। কিন্তু দ্বিতীয় কাঁধটি কোনোমতেই বের করে আনতে পারেননি। এ অবস্থায় একটু জোরে টান পড়লেই বাচ্চাটির চামড়া ছিড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তারা হালকা প্রচেষ্টার মাধ্যমে মৃত এবং পচন শুরু হওয়া বাচ্চাটিকে সম্পূর্ণ ডেলিভারিতে ব্যর্থ হন। পরে সিদ্ধান্ত নেন, এই বাচ্চাটিকে De-capitation (মাথা কেটে ফেলা), Cleidotomy (ক্ল্যাভিকল বা কলার বোন কাটা) ধরনের Destructive Operation করে ডেলিভারি করাতে।
কিন্তু বিভিন্ন কারণে উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় এই হাসপাতালে বাচ্চার ডেলিভারি করা সম্ভবপর ও বাস্তবসম্মত নয় ভেবে ওই প্রসূতিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। তখন স্বজনদেরকে ডেকে রোগীর অবস্থা দেখানো হয় এবং রোগীকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। এরপর রোগীকে ছাড়পত্র লিখে বিকেল ৩টার দিকে চিকিৎসকরা হাসপাতাল ত্যাগ করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পরবর্তীতে স্বজনেরা রোগীকে সিলেটে না নিয়ে সম্ভবত কোনো দালালের খপ্পরে পড়ে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানকার নার্স রোগীর অবস্থা এবং বাচ্চার মাথা ও একটি হাত বের হয়ে থাকা অবস্থা দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসককে বিষয়টি জানান।
রোগীর অবস্থা জানিয়ে ওই চিকিৎসক অন্য একজন গাইনোকলজিস্টকে ডাকেন। তিনি এসে রোগীকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার কথাই বলেন। কিন্তু স্বজনেরা সিলেটে না গিয়ে রোগীকে নিয়ে আবারও অন্য একটি ক্লিনিকে যায়। রোগীকে এই টানা হ্যাচড়ার কোনো এক পর্যায়ে হয়তো কেউ টানাটানি করে অথবা রোগীর দুই পায়ের ফাঁকে আটকে থাকা পচন শুরু হওয়া মাথাটি ছিড়ে গিয়ে সামান্য চামড়ার সঙ্গে ঝুলতে থাকে।
পরে এই ক্লিনিকেই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শহরের অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র গাইনোকলজিস্ট (অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক) রোগীর ডেলিভারি করান। ডেলিভারে করাতে গিয়ে তিনি বাচ্চার চামড়া এবং মাংস পচন দেখতে পান। পাশাপাশি বাচ্চার মাথা ঘাড় থেকে প্রায় পুরোটাই বিচ্ছিন্ন (সামান্ন ঝুলে আছে একদিকের চামড়ায়) এবং একটা হাতও বগলের দিক থেকে ছিড়ে যাওয়ার অবস্থায় দেখতে পান।
মা এবং স্বজনরা যাতে ওই শিশুর মৃতদেহ দেখে ভয় না পান, সেজন্য ডেলিভারির পর ওই গাইনোকলজিস্ট শিশুটির প্রায় বিচ্ছিন্ন মাথা সেলাই করে ঘাড়ের সঙ্গে জোড়া দেন। পরে মা দেখতে চাইলে কাপড় মুড়িয়ে বাচ্চাটি দেখানো হয়।
এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার জেলা বিএমএ সভাপতি ডা. শাব্বির হোসেন খান জানান, সিজারের কোনো ঘটনাই সেদিন ঘটেনি ওই রোগীর ক্ষেত্রে। সিজার কারা করতে পারে, এমন ন্যূনতম জ্ঞান যার নেই, সে কিভাবে মেডিকেল সেক্টর বিট করে? সংবাদে বলা হয়েছে “নবজাতকের মৃত্যু”। অথচ বাচ্চাটি মায়ের গর্ভেই মারা গিয়েছিল। দুপুরে রেফার করার পর সিলেটে না নিয়ে রোগীকে শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোথায় কে বা কারা বাচ্চাকে ডেলিভারীর জন্য টানাটানি করেছে, সেটা খোঁজ নিলে সঠিক ঘটনা বের হয়ে আসবে। রোগীকে নিয়ে তারা কয়টা ক্লিনিকে গিয়েছিল, সেই তথ্য কেউ জানে না। রোগীর সঙ্গে থাকা মহিলাদের কেউ ডেলিভারি করানোর জন্য বাচ্চার মাথা ধরে টানাটানি করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না”
তিনি আরও বলেন, “যে হাসপাতাল পরপর দু’বার দেশসেরা ইমার্জেন্সি অবসটেট্রিক কেয়ার হাসপাতাল (EOC Hospital) হিসেবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে আসছে, সেই হাসপাতাল সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য-প্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের চলমান স্বাস্থ্যসেবাকে কোথায় নামানোর চেষ্টা চলছে?”
সুত্র – মেডিভয়েস