শুধু তা-ই নয়, আন্ডারডগদের নিয়েও যে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনা যায়, এটা হোয়াটমোর দেখিয়েছিলেন সেই ১৯৯৬ সালে, যখন শ্রীলঙ্কা নিজেদের মাটিতে জিতেছিল বিশ্বকাপ। আশির দশকে ক্রিকেট দুনিয়ায় নবীনতম টেস্ট-শক্তি শ্রীলঙ্কাকে পরিণত করেছিলেন বিশ্বের সেরা দলগুলোর একটি।
২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর এফটিপির কল্যাণে বেশ কিছু সিরিজ খেলা হয়ে গেলেও বাংলাদেশের কাছে জয় ছিল অধরাই। জয় দূরে থাকা মানমর্যাদা বাঁচানোই তখন বিরাট ব্যাপার। ২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডার মতো দলও তত দিনে হারিয়েছে বাংলাদেশকে। কেনিয়ার সঙ্গে জেতা হয়নি। ওয়ানডেতে টানা পরাজয়ের পাশাপাশি টেস্টে একের পর এক ইনিংস হার-বাংলাদেশের ক্রিকেটের মর্যাদাই তখন প্রশ্নবিদ্ধ ক্রিকেট দুনিয়ার সামনে। এমন একটি সময় হোয়াটমোরকে দলের দায়িত্ব দিয়ে যেন দুঃসময় থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে নিতে চাইল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হোয়াটমোর। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ! কোন অস্ট্রেলিয়া? স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বাধীন সর্বজয়ী সেই দল! ডারউইন ও কেয়ার্নসে দুটি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডের সিরিজ। গোটা দেশ তখন আতঙ্কিত, কি-না-কি হয়! মানসম্মান নিয়ে ফেরা যাবে তো! এক দিনেই টেস্ট হেরে যাওয়ার সেই আলোচিত তত্ত্ব!
হোয়াটমোর দলের দায়িত্ব নিয়ে খুব বড় গলায় কিছু বলেননি। কেবল বলেছিলেন, দলের মধ্যে জয়ের খিদে ও অভ্যাসটা তৈরি করতে চান। খেলোয়াড়দের প্রতিভা যা আছে, পূর্ণ প্রয়োগ যেন তারা মাঠে ঘটাতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে খুব খারাপ করেনি সেবার বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে ইনিংস পরাজয় সঙ্গী হলেও পরের টেস্টটা ভালোই লড়েছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডেগুলোতেও অন্তত লড়াইয়ের খিদের দেখা মিলেছিল। ২০০৩ সালেই সেই লড়াইয়ের মুলতান টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ, একটুর জন্য যে টেস্টটি জেতা হয়নি। জেতা হয়নি ইনজামাম-উল হকের ব্যাটিং-বীরত্বে। পাকিস্তান সফরে কোনো ম্যাচ না জিতলেও ছিল লড়াইয়ের ছাপ।
অবশেষে হোয়াটমোরের অধীনে প্রথম জয় ধরা দেয় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ২০০৪ সালে দলটার বিপক্ষে প্রথম জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। হারারের সেই জয়টা ছিল টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রথম জয়। টানা ৪৭ ম্যাচ জয়হীন থাকার পর এক পশলা শীতল বৃষ্টি। জয়ের খিদে তৈরি করতে চেয়েছিলেন হোয়াটমোর। পূর্ণশক্তির জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই জয়টাই যেন বদলে দেয় বাংলাদেশকে। সে বছরই ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে আসে প্রথম জয়। পরের বছর ২০০৫ সালে হোয়াটমোরের অধীনেই বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পায় ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জয়। ওয়ানডে সিরিজটাও ২-০-তে পিছিয়ে পড়ে ৩-২ ব্যবধানে ছিনিয়ে নিয়েছিল হাবিবুল বাশারের দল। ২০০৫ সালে মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিতে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ে-কেনিয়াকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসার শুরুটাও হয়েছিল তাঁর সময়েই। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কা-বধ, একই বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টের সেই মহাকাব্যিক লড়াই।
চমৎকারভাবেই হোয়াটমোরের সময়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে দিনবদলের দিকে। হোয়াটমোরের সময়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, শাহরিয়ার নাফীস, নাফিস ইকবালদের মতো প্রতিভার প্রবেশ ঘটে বাংলাদেশ দলে। ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ ছিল বাংলাদেশের কোচ হিসেবে হোয়াটমোরের শেষ মিশন। তত দিনে বাংলাদেশে চারটি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। পরিণত হয়েছেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে। ২০০৭ বিশ্বকাপে হোয়াটমোরের অধীনে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। গ্রুপপর্বে ভারতকে হারিয়ে সুপার সিক্স নিশ্চিত করে সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকাকেও হারিয়েছিল বাংলাদেশ। আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে সেই আনন্দটা ম্লান হলেও বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরোনোটা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের এগিয়ে চলারই প্রমাণ। শুরুতে এমন একটা দল পেয়েছিলেন, যে দলকে নিয়ে হাসাহাসি করত ক্রিকেট বিশ্ব। সেই দলটাকেই রেখে গেলেন এমন জায়গায়-সবাই দেখে সমীহের চোখে। এখন নেপালও আশা করছে তেমন একটা ক্রিকেটীয় উত্থান-কাব্যের!
বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা ছাড়াও পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন লঙ্কান বংশোদ্ভূত এই অস্ট্রেলিয়ান কোচ। নেপালে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে রওনক বাহাদুর মোল্লা ও ক্রিকেট পরিচালক হিসেবে বিনোদ কুমার দাসকে পাশে পাচ্ছেন হোয়াটমোর। সেই ফেব্রুয়ারিতে নেপালের কোচের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন উমেশ পাতওয়াল। এরপর পদটা ফাঁকাই ছিল। হোয়াটমোরের মতো অভিজ্ঞ ও সফল কোচকে দিয়েই প্রায় এক বছর পর সেই পদটা পূরণ করল নেপাল।
আনুষ্ঠানিক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নেপাল জানিয়েছে, ‘নতুন এই চ্যালেঞ্জ নিতে ডেভ অত্যন্ত আগ্রহী। তিনি বিশ্বাস করেন নেপালে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে, ক্রিকেটে তাদের উজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ আছে।’
আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ হিসেবে দুই মৌসুম দায়িত্ব পালন করেছেন এই কোচ।