ড, শাহরিয়ার আহমেদ – স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে করাই উচিৎ নয়। “বাসা থেকে পাত্র দেখছে। কলেজে/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আমার কি এখনই বিয়ে করা ঠিক হবে?” প্রেমিক চাকরিতে জয়েন করেছে। বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কী করা উচিত এখন?”
ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপগুলোয় এই ধরনের পোস্ট প্রায়ই চোখে পড়ে। এসব পোস্টের কমেন্ট সেকশন বাঙালির জ্ঞান ফলানোর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা বলেই বোধ করি। সেখানে সবাই “রিলেশনশিপ কাউন্সিলর” বনে যান। বেশিরভাগ কমেন্টের মূলকথা এরকম যে অবশ্যই বিয়ে করে ফেলতে হবে। বিয়ের পরও “ইচ্ছা থাকলে” পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু ভালো পাত্র চলে গেলে আর পাওয়া যাবে না। আর মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে (!) বিয়ের জন্য পাত্র পাওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে দুষ্কর কাজ!
কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে একজন ব্যক্তির বিয়ে করে থিতু হওয়ার চিন্তা কি আসলেই বাস্তবসম্মত? একজন মেয়ের জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন কি তথাকথিত একজন ভালো পাত্রে পাত্রস্থ হওয়া? নাকি আমরা এখনও “সংসার সামলানো আর বাচ্চা পালা ছাড়া মেয়ে মানুষের আর কাজ কী!” নীতিতেই বিশ্বাসী? এই প্রশ্নগুলোর খুব সহজ এবং যথাযথ উত্তর যেকোনো শিক্ষিত ব্যক্তিরই ভালোভাবে জেনে রাখা এবং বিশ্বাস করা উচিত।
প্রথমেই আসে কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করার প্রশ্ন। আমাদের সমাজে একটা ছেলে মিনিমাম ইনকাম সোর্স ছাড়া সাধারণত বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারে না। তবে একটা মেয়ের ক্ষেত্রে তার ইনকাম সোর্স থাকাটা সাধারণভাবেই জরুরি ধরে নেওয়া যায় না কেন?
এখানে শুরুটা হয় মেয়ের নিজের ঘর থেকেই। দিন বদলানোর সাথে সাথে অনেক মা-বাবাই আজকাল মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে উদার হলেও তাদের কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতা দিতে অনেক ক্ষেত্রেই নারাজ। তাদের ধারণা বিয়ের পর মেয়ে অন্য ঘরেই চলে যাবে। বরের একটা ভদ্রস্থ ইনকাম থাকলেই মেয়ের সকল চাহিদা পূরণ হবে। এতোদিন যেমন মা-বাবা মেয়ের যাবতীয় চাওয়া পাওয়া মিটিয়ে এসেছেন, বিয়ের পর সেই দায়িত্ব মেয়ের বর পালন করবে। মেয়ের দায়িত্ব কেবল তার বর আর শ্বশুরবাড়ির সব সামলে চলা।
এখানেই অধিকাংশ মা বাবা তাদের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেন। পুত্র এবং কন্যা সন্তান উভয়কেই পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের কর্মক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যেতে হবে পরিবার থেকেই। জন্মের পর থেকে কষ্ট করে লালন পালন করে পরের ঘরে পাঠিয়ে দিলেই অভিভাবকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সন্তান যেন তার মা-বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে তাকে সে যোগ্যও করে তুলতে হবে। বয়স্ক মা-বাবার দেখভাল করার দায়িত্ব শুধু পুত্র সন্তানের না। আবার পরিবারে পুত্র সন্তান না থাকলে মা-বাবার শেষ ভরসা নেই ভাবাটাও যুক্তিযুক্ত না। কন্যা সন্তানদের অবশ্যই যথেষ্ট স্বাবলম্বী হয়ে নিজের ও তার মা-বাবার দেখভালের যোগ্য হতে হবে। যতদিন পর্যন্ত মেয়েদের মানসিকতায় এই দায়িত্ব নেয়ার দৃঢ় মনোভাব না আসবে ততদিন পর্যন্ত নারী স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থাকবে।
মেয়ের পরিবার যদি তার কর্মক্ষেত্রের ক্ষেত্রে উদারও হয়, এর পরের ধাপে বাধ সাধে স্বাবলম্বী নারীর জন্য পাত্র খোঁজায়। এই সমাজে এখনও বিয়ের জন্য মেয়েদের স্বাবলম্বিতাকে নেগেটিভ পয়েন্ট হিসেবেই ধরা হয়। এক্ষেত্রে প্রধান যুক্তিগুলো হলো, “মেয়ের উপার্জনে সংসার চলবে নাকি? ছেলে কি কম টাকা কামায়! ভদ্রঘরের ছেলেরা বউয়ের উপার্জন খায় না। লোভীরাই শুধু মেয়ের ক্যারিয়ার দেখে বিয়ে করে।” এছাড়াও আছে দুনিয়ার সর্বোচ্চ জটিল প্রশ্ন, বিজ্ঞান যার উত্তর আজও খুঁজে পায়নি! তা হলো, “বউ বাইরে কাজ করলে ঘর সামলাবে কে?”
প্রথমত উপার্জন করে সংসার চালানোর দায়িত্বটা শুধু ছেলের কাঁধেই চাপাতে হবে? কেন একটা ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই সংসারের ঘানি টানার চিন্তা মাথায় নিয়ে মানসিক চাপে জীবন পার করতে হবে? আর যে ঘরে বউয়ের উপার্জনকে ভদ্রতার পথে বাধা হিসেবে দেখা হয়, সে ঘরকে ভদ্রঘরের তকমা দিলো কে?
আবার ঘর সামলানোর ঠ্যাকাটা শুধু মেয়ের কাঁধেই চাপবে কেন? সাবলম্বী শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো নিজেই নিজের অবলম্বন হওয়া। এর মানে যেমন নিজ যোগ্যতায় উপার্জন করতে জানা, সেই সাথে নিজের ঘর সামলানোর যোগ্যতা অর্জন করাটাও সাবলম্বিতার অন্যতম শর্ত। তো যে ছেলে শুধু উপার্জন করার দায়িত্ব নিয়ে ঘরে বাকি সমস্ত কাজ স্ত্রী-র কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার চিন্তা করে, সে ছেলেকে স্বাবলম্বী মনে করে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা আছে কি?
সৎ পথে নিজের যেকোনো উপার্জন ব্যক্তির কাছে কাছে পরম গর্বের। মেয়ে হওয়ার কারণে একজন ব্যক্তিকে কেন এই গর্বের ভাগীদার হওয়া থেকে আটকানো হবে? নিজের ছোট থেকে বড় যেকোনো চাহিদা মেটানোর জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকাটা কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য খুব একটা গর্বের বিষয় হতে পারে না।
ফেসবুকীয় “রিলেশনশিপ কাউন্সিলর”দের আরেকটা বড় সমাধান হলো, “ইচ্ছা থাকলে বিয়ের পরও পড়ালেখা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।” কথাটা অবশ্য মিথ্যা না। কিন্তু বিয়ের পর পড়ালেখা শেষ করে কয়জন মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছেন তা ভাববার জন্য একদিন সময় বের করে নিবেন। আঙ্গুল গুনে যে কয়জনের উদাহরণ বের করতে পারবেন তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে সংগ্রামগুলোও সে ব্যক্তি থেকে জেনে নিবেন। মেয়ের বিয়ে পরবর্তী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছাটা যে আর কেবল নিজের ইচ্ছা থাকে না। তখন মেয়ের বর, বরের পরিবারের সবার ইচ্ছা আর প্রায়োরিটিটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সবক্ষেত্রেই যে পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকে তা বলছি না। কিন্তু বাড়ির বউ এর কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার পথটা অনুকূল হওয়ার সম্ভাবনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মরীচিকা থেকে যায়।
পারিবারিক সহিংসতার দিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই প্রথম সারিতে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (নিপোর্ট) পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ নারী বিবাহিত জীবনে শারীরিক নির্যাতনের শিকার। কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার হার বাড়লে সকল ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ করার সক্ষমতাও বাড়তো। প্রতিষ্ঠিত নারী সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে মুক্তির উপায়ও খুঁজে পেত।
খুব সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্রী সুমাইয়া খাতুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ধরা যাক। ধারণা করা হচ্ছে সুমাইয়া খাতুনের সরকারী চাকরি করার ইচ্ছার বিরোধিতা করে নির্যাতন করতে করতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ২০১৯ সালে বিয়ের পর থেকে সুমাইয়া খাতুন প্রায়ই শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হতেন। এর মাঝেও পড়ালেখা সম্পূর্ণ করে চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত আর পার পেলেন না। মেয়ে হয়েও উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত হবার মতো এতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণের মূল্য মেটাতে হলো তার জীবন দিয়ে।
কিন্তু আর কয়েকটা বছর নিজের পরিবারে থেকে বিয়ের আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম করতে পারলে তার জীবনের কাহিনীটা কি অন্যরকম হতো না? আপাতদৃষ্টিতে ভদ্রঘরে পাত্রস্থ করে সুমাইয়া খাতুনের মা-বাবা কী তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারলেন? প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিয়ে করলে সুমাইয়া খাতুন হয়ত এরকম বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার মনোবলও রাখতে পারতেন।
আমাদের আশেপাশেই সুমাইয়া খাতুনের মতো রোজ অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট হয় শুধু বিয়ের আগে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায়। সবাই হয়তো নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায় না, বা দৃশ্যমান নির্যাতনও তাদের উপর হয় না। বেশিরভাগেরই মানসিক অশান্তির বোঝা নিয়ে সারাজীবন পার করতে হয় চুপ করে থেকে।
তাই মেয়েরা সময় থাকতে সৎপাত্রে পাত্রস্থ হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকুন। নিজেকে সময় দিন, নিজের জন্য প্রতিষ্ঠিত হোন। বিশ্বাস করুন এতে আপনি, আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিবার সবাই ভালো থাকবেন।
—— সংগৃহীত ও সংযোযিত – ড, শাহরিয়ার আহমেদ (সম্পাদক- দৈনিক সমাজের কন্ঠ)