সমাজের কন্ঠ ডেস্ক – যশোরের কান্না ভবদহে আবারও জলাবদ্ধতা। টিআরএম প্রকল্পের বিকল্প নাই। যশোর জেলার অন্তর্গত অভয়নগর উপজেলা সহ মনিরামপুর, কেশবপুর এবং ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এলাকার আংশিক এলাকা জুড়ে থাকা ভবদহের জলাবদ্ধতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। ভবদহের এই জলাবদ্ধতা দুর করতে সরকারী পর্যায়ে এ পর্যন্ত অনেক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হলেও ভবদহবাসীর দুঃখ দুঃখই রয়ে গেছে, এই সমস্যা যেনো কোনোভাবেই কাটতে চাইছে না। এই সমস্যা নিয়ে অভয়নগর উপজেলা সহ যশোর জেলা শহরেও আন্দোলন হয়েছে অনেকবার! দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কান্না ভবদহের এই জটিলতা নিরসনের দাবি বহুদিনের। প্রায় আড়াই যুগ পরে এসেও ভবদহবাসীর দুর্দশা দুর করা যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৬১ সালে ভবদহ এলাকার ৫টি জায়গায় মোট ৪৪টি সুইজ গেট স্থাপন করে। এরপর থেকে আশেপাশের নদ-নদীর নাব্য হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৮১ সালের পর থেকে শুরু হয় জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে এলাকাবাসী ১৯৯৭ সালে নদীর বেড়িবাঁধ কেটে জোয়ারের পানি পাশের ভায়না বিলে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সরকার থেকে ভবদহে ‘টিআরএম’ (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট)প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ফলে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভবদহে আর কোনো জলাবদ্ধতা হয়নি। এরপর এ অঞ্চলকে ঘিরে আর গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পরের ৩ বছর আবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ২০০৭ সালে বিল খুকসিয়ায় সরকার আবার ‘টিআরএম’ চালু করে। এর পরের কয়েক বছর আবার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায় ভবদহবাসী। সর্বশেষ গত ৩ বছর ভবদহ অঞ্চলে আবার জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বর্তমানে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে এলাকার কোনো বিলে ‘জোয়ারধার’ (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-টিআরএম) কার্যকর নেই।। সরকারী পর্যায়ে এই সমস্যার অন্যতম সমাধান হিসেবে ‘জোয়ারধার’ পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। মূলত, নদীসংলগ্ন বিলে বাঁধ তৈরি করে নদীর পাড় কেটে দিয়ে জোয়ারের সঙ্গে নদী দিয়ে আসা পলি বিলে জমা হতে দেওয়া হয়। এতে নদীর নাব্য অটুট থাকে। বিলে বাঁধ দিয়ে ‘টিআরএমের’ মাধ্যমে পলি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘জোয়ারধার’। পলি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতি যশোরের এই অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে এবং পরে সরকারিভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবহার করা হতো। এই ব্যবস্থার ফলে ভবদহে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হতো না। এ বাস্তবতায় বর্ষা মৌসুমে যে বছর ‘জোয়ারধার’ কার্যকর না থাকে সে বছর যশোরের ভবদহ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের দুঃখের অন্ত থাকে না। গত ২/৩ বছর ধরে ভবদহ অঞ্চলে আবার ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ভবদহে শত শত গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান নষ্ট হয়ে যায়। পানিবন্দি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। এই অস্বাভাবিক জীবনযাত্রার ফলে ভবদহবাসীর জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। ফলে ভবদহ অঞ্চলের সার্বিক জীবন ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবসহ অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। এলাকার কোনো বিলে বর্তমানে জোয়ারধার(টিআরএম)কার্যকর না থাকায় পলি জমে নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের প্রায় ২৭টি বিলসহ ভবদহের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ মুক্তেশরী-টেকা-শ্রী-হরি নদীর তলদেশ পলিতে ভরে নাব্য হারিয়েছে। আশেপাশের কোনো বিলে ‘জোয়ারধারের’ মাধ্যমে নদীর পলি অবক্ষেপণ করলে বিলগুলো যেমন উঁচু হবে তেমনি নদীর গতিও ঠিক থাকবে। ভবদহ সুইজ গেটের উজান ও ভাটিতে পলি পড়ে আশীর্বাদের সুইজগেট এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সাগর থেকে আসা জোয়ারের পানি প্রতিদিন দুবার নদীগুলো (মুক্তেশরী, টেকা ও শ্রী হরি) দিয়ে ভবদহ অঞ্চলে প্রবেশে করে। আবার ভাটির সময় পানি সাগরে ফিরে যায়। এভাবে পলি পড়ে পড়ে নাব্য হারিয়েছে নদীগুলো। এ অবস্থায় জলাবদ্ধতা থেকে দ্রুত নিস্তার মিলছে না ভবদহবাসীর! তবে এই খনন কাজ হচ্ছে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীভাবে। দায়সারাভাবে কাজ করার ফলে তা কোনো কাজেই আসছে না! এক নদীতে খনন করতে করতে অন্য খননকৃত নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী দিয়ে প্রচুর পলি আসছে। খনন করে যে পরিমাণ মাটি কাটা হচ্ছে তা আবার পলিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর মাটি কেটে নদীর পাড়েই স্তূপ করে রাখা হচ্ছে! সেই মাটির স্তূপ ভেঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আবার নদীতেই পড়ছে! আবার নদী গভীর করে কাটা হচ্ছে না। এই সব কারণে যেনতেনভাবে নদী খনন করে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসন করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না! এবারও জলাবদ্ধতা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আর কতকাল চলবে এই জলাবদ্ধতা? ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘জোয়ারধার’ যেমন কার্যকর রাখতে হবে তেমনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখতে হলে নদ-নদীগুলোও নাব্য সংকট থেকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু সরকার কেন ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘টিআরএম’ প্রকল্প কার্যকর করতে পারছে না ? কারণ হলো স্থানীয় চিংড়ি ঘেরের মালিক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে (টিআরএম)চালু করতে হবে।।