কুড়িগ্রাম ফুলবাড়ীতে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া ৩ শিক্ষার্থী অতি দরিদ্র।পড়ালেখা অনিশ্চিত

0
3

আজিজুল হক নাজমুল (কুড়িগ্রাম) – ফুলবাড়ীতে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যারা অতি দরিদ্র। যাদের একজন চা বিক্রি করে সংসার চালিয়ে নিজের পড়াশুনা চালিয়েছে, একজন দিনমজুরের কাজ করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করেছে এবং একজন দিনমজুরের কন্যা। এই তিনজনের নাম, প্রদীপ পাল, শাহারিয়া হোসাইন এবং সাবিনা ইয়াছমিন নিথী। দরিদ্র পরিবারের এই তিন সন্তানের এখন উচ্চ শিক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও অর্থের অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারবে কি-না সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নয়। প্রদীপ পাল প্রদীপ পালের বাবা শ্যামল চন্দ্র পাল একজন ক্ষুদ্র চা বিক্রেতা। মা মলি রানী পাল গৃহিনী। বালারহাট বাজারে ছোট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেসহ চা বিক্রি করে কোন রকমে চলে তাদের সংসার। সংসারের সীমাহীন দারিদ্র্য প্রদীপকে পড়ালেখা থেকে দুরে রাখতে পারেনি। প্রদীপ পালের বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেষা বালাতাড়ি গ্রামে। শ্যামল পালের দ্বিতীয় ছেলে প্রদীপ পাল। শ্যামল পালের বড় ছেলে মলয় পাল ও ছোট ছেলে প্রদীপ পাল চা বিক্রির পাশাপাশি নিয়মিত স্কুলে যেত। বড় ছেলে মলয় পাল ২০১৭ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৩ পয়েন্ট পেয়েছে। সে বর্তমানে চলতি এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ছোট ছেলে প্রদীপ পাল ২০১৬ সালে জেএসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এবং বালারহাট আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সে এবারও এসএসসিতে জিপি এ-৫ পেয়ে গরীব বাবা-মার মূখে হাসি ফুটিয়েছেন। সরেজমিনে দেখা যায় বাবা-মা দুজনেই ছেলেকে কোন কলেজে ভর্তি করাবেন তা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এরপরেও নেই তাদের টাকা পয়সা। বাবা শ্যামল পাল বলেন, ‘আমরা বাপ-ছেলে মিলে চায়ের দোকানে চা বিক্রি করে কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে দুই ছেলের পড়ালেখায় ছিলাম সচেতন। তাদের মাঝে মাঝে বলতাম, আমাদের অভাবের সংসার। নেই জমিজমা। চা বিক্রি করেই আমাদের চলতে হয়। কলেজে ভর্তির জন্য মেধাবী প্রদীপের পরিবারের অর্থ না থাকায় উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইচ্ছা থাকলেও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে মেধাবী প্রদীপ পালের।’ শাহারিয়া হোসাইন জিপিএ-৫ পেয়ে অর্থের অভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি হতে পারবে কি না তা নিয়ে শংকায় পড়েছে শাহারিয়া হোসাইন ও তার দরিদ্র পরিবার। উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গোরকমন্ডপ গ্রামে দিনমজুর মমিনুল হকের ছেলে। মমিনুল হকের দুই ছেলে এক মেয়ে। শাহারিয়া হোসাইন সবার বড়। ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েটা সবার ছোট। পরিবারে অভাব থাকায় ছোটবেলা থেকে বালাতাড়ি গ্রামে নানা বাড়িতে থাকেন শাহারিয়া হোসাইন। নানাবাড়িতে থেকে টিউশনি ও দিনমজুরের কাজ-কাম করে এবারে বালারহাট আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অভাবের তাড়নায় ইচ্ছা থাকলেও ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে বসেছে শাহারিয়া হোসাইন। শাহারিয়া হোসাইন জানান, নানাবাড়িতে থাকলেও সে নিজে কোন সময় টিউশনি ও এমনকি দিনমজুরীর কাজ করে পড়ালেখার খরচ যোগাড় করেছে। শিক্ষক আর বন্ধুদের সহযোগিতায় এসেছে এতদূর। অর্থাভাব আর বাবা-মায়ের আর্থিক সামর্থ না থাকায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় করছে শাহারিয়া হোসাইন। এখন সমাজের বৃত্তবানদের সহযোগিতাই পারে তার স্বপ্ন পূরণ করতে। বাবা দিনমজুর মমিনুল হক জানান, অভাবের সংসারে ৫জন সদস্য। যে দিন কাজ জোটে সেদিন ভালমন্দে মুখে ভাত ওঠে। আর কাজ না জুটলে তিনবেলা খাবার থাকে না। ধারদেনা করে কোনরকমে সংসার চলে। মা শাহানাজ বেগমও অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। মেধা দেখে দিন মজুরীর কাজ-কাম করে ছেলেকে জুগিয়েছেন পড়ালেখার খরচ। পড়ালেখার খরচ যোগাড় করতে শাহারিয়া হোসাইনের অবসর সময় দিনমজুরের কাজ করে আজ এতদূর আসতে পেরেছে। আগামীতে কিভাবে ওর পড়াশুনা চলবে তা নিয়ে দুশ্চিতায় কাটছে পরিবারের সবার। সাবিনা ইয়াছমিন নিথী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বালারহাট আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ গোল্ডেন-৫ পেয়েছে সাবিনা ইয়াছমিন নিথী। নিথি ২০১৩ সালের পিএসসি ও ২০১৬ জেএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে গরীব বাবা-মার সুনাম অর্জনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম অর্জন করেছে। নিথী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেষা কৃষ্ণানন্দবকসি গ্রামের দিন মজুর ইউসুফ আলীর মেয়ে। দিনমজুর ইউসুফ আলী এলাকায় দিনমজুর কাজের পাশাপাশি মেয়ে-ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগাতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। স্বল্প আয়ে মেয়ে নিথী ও ছোট ছেলে লুৎফর রহমানের স্কুলের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হয় তাকেও। মা আদরী বেগম নিজ বাড়িতে গৃহীণির কাজ শেষে আবার কোন কোন দিন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। অভাবের সংসারে কিভাবে মেয়ের পড়ালেখার কাজ চালাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না নিথীর বাবা-মা। তাদের একমাত্র সম্পদ ভিটেবাড়ির পাঁচশতক জমি। সাবিনা ইয়াছমিন নিথী বলে, ‘আমার গরীব বাবা-মা কিভাবে আমাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি করাবে ভেবেই পাচ্ছি না। তার ওপর সামনের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার সাধনা যেন তার পূর্ণ হয় সে জন্য সকলের কাছে দোয়া চাই।’ সাবিনা ইয়াছমিন নিথীর স্বপ্ন সে ডাক্তার হয়ে সমাজের গরীব দুঃখীদের পাশে দাঁড়াতে চায়। মা আদরী বেগম জানান, ‘ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করায় আরো দুশ্চিতায় পড়া লাগে বেশি। মেয়ে আমার ভালো ফল করেছে। এখানে আনন্দ যেমন, তার চেয়ে বাবা-মা হিসেবে কষ্ট অনেক বেশি। মেয়েটা হামার ডাক্তার হবার চায়। কটে ভর্তি হবে, টাকা কটে পামো। বাড়িভিটা পাঁচ শতক জমি ছাড়া আর কিছুই নাই হামার। এরপরেও ঘরে থাকে না খাবার, থাকে না টাকা পয়সা। তাদের পরিবারে ছোট ছেলেটি দশম শ্রেণিতে পড়ছে। সামনের দিনে ছেলে ও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ কিভাবে মিটবে ভেবেই পাচ্ছে না তার পরিবার। এ নিয়ে নির্ঘুম পার করছে পরিবারের সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here