বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে মাইডাস ভবনে টিআইবির কার্যালয়ে এ জরিপ তুলে ধরা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক পরিচালিত ‘সেবাখাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৬.৫% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা থেকে এক হাজার ৩৯২ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৩০ টাকা।
জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৮ হাজার ৮২১.৮ কোটি টাকা থেকে এক হাজার ৮৬৭.১ কোটি টাকা বা ২১.২% বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬৮৮.৯ কোটি টাকা, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪% এবং বাংলাদেশের জিডিপির ০.৫%।
জরিপে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭২.৫%), পাসপোর্ট (৬৭.৩%), বিআরটিএ (৬৫.৪%), বিচারিক সেবা (৬০.৫%), ভূমিসেবা (৪৪.৯%), শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) (৪২.৯%) এবং স্বাস্থ্য (৪২.৫%)।
ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটি চিহ্নিত করেছে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৮৯% খানা, ২০১৫ সালে যার হার ছিল ৭০.৯%। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের খানাগুলোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকৃতি ও মাত্রা নিরূপণসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিপারপাস সেম্পলিং ফ্রেমের আলোকে দেশের আটটি বিভাগে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের সমন্বয়ে তিন পর্যায় বিশিষ্ট স্তরায়িত গুচ্ছ নমুনায়ন পদ্ধতিতে জরিপটি পরিচালিত হয়।
জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত খানাসমূহ ১৫টি প্রধান ও অন্যান্য খাতে যেসব সেবাগ্রহণ করেছে তার ওপর ভিত্তি করে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ ২০১৮ জরিপের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।
জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আটজন বিশেষজ্ঞের সার্বিক সহায়তা ও পরামর্শ গৃহীত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্ব ও প্রভাব রয়েছে এমন ১৫টি প্রধান খাতসহ ওয়াসা, বিটিসিএল ও ডাকসেবাকে ‘অন্যান্য খাত’ হিসেবে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৫টি প্রধান খাত হলো-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমিসেবা, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বিমা এবং গ্যাস।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, বিআরটিএ, স্বাস্থ্য (সরকারি), বিমা ও এনজিও খাতে দুর্নীতি বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমিসেবা, কর ও শুল্ক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খাতে দুর্নীতি কমেছে।
তবে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। আবার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কৃষি, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, বিমা, স্বাস্থ্য (সরকারি), গ্যাস ও এনজিও খাতে ঘুষের শিকার খানার হার বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), পাসপোর্ট, ভূমিসেবা, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং খাতসহ ‘অন্যান্য খাত’ (ওয়াসা, বিটিসিএল, ডাকসেবা ইত্যাদি) এ ঘুষের শিকার খানার হার কমেছে।
তবে সার্বিকভাবে ঘুষের হার কমলেও দায়িত্বপালনে অনীহা, অসদাচরণ ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপ প্রভৃতি অনিয়ম-দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাশাপাশি হয়রানি বা জটিলতা এড়ানো, নির্ধারিত ফি জানা না থাকা এবং নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়া খানার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্থসামাজিক অবস্থানভেদে দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার হারের তারতম্য লক্ষণীয়। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত ও দরিদ্র খানাসমূহ দুর্নীতির শিকার বেশি হচ্ছে।
এছাড়া উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের খানার ওপর দুর্নীতির বোঝা অপেক্ষাকৃত বেশি। সেবাগ্রহণকালে উচ্চ আয়ের খানাগুলো বার্ষিক আয়ের ০.১২% এবং নিম্ন আয়ের খানাগুলো বার্ষিক আয়ের ২.৪১% ঘুষ দিতে বাধ্য হয়।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না- এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। যাদের ওপর দায়িত্ব তারা দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনছেন না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে কী করতে হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।