বরিশাল গৌরনদী উপজেলার উত্তর বাটাজোর গ্রামের অসহায় মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ কর। তিনি গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা (নং ৪৬৩১৯) তিনি গেজেটভুক্ত হওয়ার পরও পাচ্ছেননা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি ৬৬ বসর বয়েসেও ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন! গোবিন্দ কর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ভারতের তালিকায় ৪৬৩১৯ নং গেজেটভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার দেওয়াপাড়া উত্তর বাটাজোর গ্রামের হরলাল করের পুত্র গোবিন্দ কর দেশকে স্বাধীন করার লক্ষে জীবন বাজি রেখে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পাকবাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনলেও জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে তিনি আজ পরাজিত সৈনিক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্ত্রী, সন্তান, প্রিয়জনসহ বাড়িঘর হারিয়ে তিনি আজ নিঃস্ব। বর্তমানে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
বৃদ্ধ বয়সে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৭১ সালের রণাঙ্গন কাঁপানো সেই গেরিলা যোদ্ধা। কয়েকদিন আগে ভ্যান চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় তার ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসাও চলছে না তার। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার আশায় তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। নিরুপায় হয়ে ভাতা পাবার আশায় তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ কর বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৮মে সকালে বাটাজোর এলাকায় পাকহানাদাররা প্রবেশ করে। তাদের সহযোগী ছিল স্থানীয় ক্যাম্পের কয়েকজন রাজাকার। তারা আধুনা, বছার, চন্দ্রহার এলাকায় প্রবেশ করে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং গুলি করে নিরীহ লোকজন মারতে থাকে। পাকসেনারা সেদিন আমাদের ঘরবাড়িও পুড়িয়ে দেয়। এলাকায় মিলিটারি আসছে খবর পেয়ে জীবন বাঁচাতে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যসহ হিন্দু পরিবারের প্রায় ৪ শতাধিক নারী-পুরুষ হরহর মৌজার মরার ভিটা নামক একটি নির্জন স্থানে আশ্রয় নিই। কিন্তু রাজাকারদের সহায়তায় নরপশুরা ওই স্থানে হানা দিয়ে ১৩৫ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ লোককে হত্যা করে।’
সেই থেকে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে গবিন্দ করের অন্তরে। ওই ঘটনার পরের দিনই তিনি ট্রেনিং গ্রহনের উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন। হাসনাবাদ চাকুলিয়া ক্যাম্পে এক মাসের ট্রেনিং শেষে অবস্থান নেন তৌকিতে। সেখান থেকে ৭১ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে ভোলার দৌলাতখান এলাকার যুদ্ধকালীন কমান্ডার আলী আকবর ও প্লাটন কমান্ডার ইব্রাহিম মিয়ার সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন। নিজ এলাকায় এসে যুদ্ধ করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও নিয়ম অনুযায়ী তাকে ভোলায় যেতে করতে হয়। এ কারণে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ওই এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তার সহযোদ্ধারা হলেন, দৌলতখান এলাকার রফিকুল ইসলাম, রনজিৎ, শওকত আলী, চিত্ত রঞ্জন, রাজেনসহ অন্যান্য ৬৩ জন মুক্তিযোদ্ধা।
প্রথম দিনের যুদ্ধে তারা দৌলতখান থানা পাকহানাদারমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। দ্বিতীয়বার দৌলাতখানের বর্তমান বাংলাবাজার (টনির হাট) নামক স্থানে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ওই যুদ্ধে তার সহযোগী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। গবিন্দ করসহ আহত হন কয়েকজন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গবিন্দ এলাকায় ফিরে এসে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। তার স্ত্রী জুরানী কর ৩ বছরের একটি কন্যা সন্তান রেখে ৭৬ সালে মারা যান। এর কিছুদিন পর মেয়েটিও মারা যায়। এরপর থেকে শোকে পাগল হয়ে এলাকা ছাড়েন গোবিন্দ কর। দীর্ঘ ৪২ বছর যাবৎ তিনি ভবঘুরে জীবন যাপন করেন। সুস্থ হয়ে বছরখানেক আগে তিনি পুণরায় এলাকায় ফিরে আসেন।
এতদিনে জাল কাগজপত্র তৈরি করে গবিন্দ করের বাড়িঘর ও সহায়-সম্পত্তি একটি চক্র দখল করে নেয়। নিরুপায় হয়ে তিনি বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের বাড়িতে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা চাঁদা তুলে তাকে একটি অটোভ্যান কিনে দেন। ভ্যান চালিয়ে যা পান তা দিয়ে কোন মতে জীবিকা নির্বাহ করছেন মুক্তিযোদ্ধা গবিন্দ কর। বর্তমানে হৃদরোগসহ নানা রোগে ভুগছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
গৌরনদীর বাটাজোর ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ ইসমাত হোসেন রাসু সহ এলাকার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, গোবিন্দ কর একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এখনও ভাতা পাচ্ছেন না। অথচ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও গৌরনদীতে ভুয়ারা অনেকেই ভাতা তুলছেন। এ ব্যাপারে গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান খালেদা নাছরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘ভারতীয় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন না এটা দুঃখজনক। ওই মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে আবেদন করলে আমি এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেব।’